চাকরি-ব্যবসা কিছুই নেই, পেশায় গৃহিণী। এ কারণে তার আয়ের কোনো উৎসও নেই। আয়-রোজগার না থাকলেও খোদ ঢাকাতেই তিনি ১০টি প্লটের মালিক। এছাড়াও আছে ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ভাগ্যবান এই নারী আলোচিত সোনা কারবারি মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ লুকাতে স্ত্রীকে মালিক বানালেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। দুদকের কাছে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে প্লট-ফ্ল্যাটের তথ্য গোপন করেও কাজ হয়নি। সংস্থাটির অনুসন্ধানে তার আয়বহির্ভূত সম্পদের পাহাড় বেরিয়ে এসেছে। অবৈধ পথে অর্জিত ও জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলে রাখার অপরাধে রওশন আক্তারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২৭(১) ধারায় মামলা রুজুর সুপারিশও করা হয়েছে। একই সঙ্গে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে মনিরের দুই বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদারের বিরুদ্ধে। তারা হলেন উত্তরার জমজম টাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান হায়দার আলী ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে সোনা শফিক। এ ঘটনার অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন দুদকের উপপরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরী। তাকে সম্প্রতি পটুয়াখালী বদলি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পেয়ে রওশন আক্তারসহ অন্যরা সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দাখিল করা হিসাবের বাইরেও অনেক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা যায়, আলোচিত সোনা কারবারি মনির হোসের ওরফে গোল্ডেন মনির র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তার বিপুল ধনসম্পত্তির বিষয়টি সামনে আসে। তখন থেকেই মনিরসহ তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সম্পদের খোঁজে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই ধারাবাহিকতায় মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ করে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর তাকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেওয়া হয়। দুদকের কাছে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তিনি জমি, প্লট, ফ্ল্যাটসহ ১ কোটি ৯০ হাজার ৯৯ টাকার স্থাবর সম্পদ দেখান। ব্যাংক স্থিতি, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, স্বর্ণালংকারসহ অস্থাবর সম্পদ দেখান ২ কোটি ৭৫ লাখ ৩২ হাজার ১৯৪ টাকার। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ২২ হাজার ২৯৩ টাকার সম্পদের ঘোষণা দেন তিনি। সম্পদ বিববণীর সূত্র ধরে দুদকের অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। ঘোষণাপত্রে তিনি ১ কোটি ৯০ হাজার টাকার জমি, প্লট, ফ্ল্যাট থাকার কথা জানান। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে রওশন আক্তার শুধু রাজউকেরই ১০টি প্লটের মালিক। গত ৫ জানুয়ারি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে দুদকের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, রওশন আক্তার ঢাকা জেলার বাড্ডা (নতুন) ৫ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লট, ৭ নম্বর প্লট, ৯ নম্বর প্লট, ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর প্লট, ৩৪ নম্বর প্লট, ৬ নম্বর রোডের ৮১ নম্বর প্লট, ২১ নম্বর প্লট, ১৪ নম্বর রোডের ১ নম্বর প্লট, ৯ নম্বর রোডের ৯ নম্বর প্লট ও ১৩ নম্বর রোডের ৩ নম্বর প্লটসহ মোট ১০টি প্লটের মালিক। এসব প্লটের তথ্য তার সম্পদ বিবরণীতে গোপন করা হয়। রাজউক থেকে একই ব্যক্তি একের অধিক প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে রওশন আক্তার কী করে রাজউকের ১০টি প্লটের মালিক হলেন। এ তথ্য খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, রাজউক থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি প্লট পাওয়ার পর নানা জটিলতায় পড়েন। গোল্ডেন মনির ওইসব প্লট তার স্ত্রীর নামে কিনে নেন। এরপর রাজউক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে জটিলতাগুলো দূর করে জমির দখল নেন। দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে বলেছেন, রওশন আক্তার সম্পদ বিবরণীতে অসৎ উদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য প্লটগুলোর তথ্য গোপন করেছেন। অনুসন্ধানকালে প্লটগুলোর মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মামলা রুজুর পর প্লটগুলোর সংশ্লিষ্ট নথি জব্দ করে গোপন করা সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য অনুসন্ধানকালে রওশন আক্তারের ১৯৮৯-১৯৯০ থেকে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের আয়কর নথি সংগ্রহ করে দুদক। সেগুলো পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, তার বার্ষিক পারিবারিক ব্যয় ৫০ লাখ ৪ হাজার ৭৭১ টাকা। পারিবারিক ব্যয়সহ তার নামে মোট ৪ কোটি ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৬৪ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লিখিত সম্পদ অর্জনের বিপরীতে আয়কর নথি অনুযায়ী, রওশন আক্তারের সর্বমোট ২ কোটি ৩৯ লাখ ৬০ হাজার ১২১ টাকার আয়ের উৎস দেখানো হয়েছে। এক্ষত্রে স্বামী মনির হোসেনের অসাধু উপায়ে অর্জিত এবং জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ১ কোটি ৮৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬০৩ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ তিনি ভোগদখলে রাখায় শাক্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২৭(১) ধারায় মামলা রুজু করা যেতে পারে। হায়দার আলীর বিরুদ্ধেও মামলার সুপারিশ : অনুসন্ধানকালে গোল্ডেন মনিরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট উত্তরার গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. হায়দার আলীর স্থাবর-অস্থাবর ৫ কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ২৯১ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে তার আয়কর নথি পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিশ্চিত হয়েছেন হায়দার আলী জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ২ কোটি ৬৭ লাখ ১৫ হাজার ৬ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে দখলে রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে অনুসন্ধান কর্মকর্তা বলেছেন, হায়দার আলী মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের ব্যবসায়িক অংশীদার ও বন্ধু। গোল্ডেন মনিরের বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত। হায়দার আলীর প্রকৃতপক্ষে আয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো উৎস নেই। তিনি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন, যা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ মর্মে প্রাথমিকভাবে তথ্যপ্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মামলা তদন্তকালে আরও কোনো সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জিত হয়েছে মর্মে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে তা আমলে নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকও অবৈধ সম্পদের মালিক : গোল্ডেন মনিরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরেক ব্যক্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে সোনা শফিক। তার সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি (শফিক) ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়েছে। শফিক ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীর আলোকে অনুসন্ধানকালে দুদক কর্মকর্তা তার আয়কর নথি পর্যালোচনা করেন। পর্যালোচনায় তার ১২ কোটি ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৭ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ১১৮ টাকার বেশি সম্পদ পাওয়া যায়, যা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বলে প্রতীয়মান হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শফিকুল ইসলাম সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারির ফাঁকে নানা রকম দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জিত অবৈধ অর্থের দ্বারা নিজ নামে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ১১৮ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে ভোগদখল করছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ব্যাপারে শনিবার বিকালে শফিকুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন পাঠিয়ে বক্তব্য চাইলেও তিনি জবাব দেননি।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

ডায়ালসিলেট এ/

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *