তালিকা রাজনীতিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ৯:২১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৫, ২০১৯

তালিকা রাজনীতিতে বাংলাদেশ

ডায়ালসিলেট ডেস্ক:তালিকা-অভিযানের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন পালাবদলে সব সময় তালিকা হয়েছে। কিন্তু তালিকা সব সময় সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। অভিজ্ঞরা বলছেন, অতীত ইতিহাসে যতবারই তালিকা হয়েছে, সেই তালিকার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। চলমান তালিকার চমক হলো, এই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে তালিকা হলো। কিন্তু তাতেও কতগুলো অসঙ্গতি আছে। যেমন যুবলীগ হঠাৎ আলোচনায় এলো। এরপর কাউন্সিলররা এলেন।
কয়েকজন কাউন্সিলর ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আরো এক ডজনের বেশি গ্রেপ্তার এড়াতে নজরের আড়ালে চলে গেছেন।
গত পুরো একটা দশক গেল এক এগারোতে দায়ের হওয়া দুর্নীতির মামলা নিয়ে। এক এগারোতে টাস্ক ফোর্স হয়েছিল। সেই অভিযানও গোড়ায় বাহবা কুড়িয়েছিল। বড় বড় শিরোনাম তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সেই অভিযান সবার জন্য সমান ছিল না। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। জন্ম দেয় নানা বিতর্কের।

ইতিহাসের প্রতিটি তালিকাই একটা চমক সৃষ্টি করে। শিরোনাম তৈরি করে। বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা সব সময় রমরমা খবরের খাদ্যে পরিণত হয়। কিন্তু এরপরে একটা সময়ে সেটা থেমে যায়। এবারে যাবে কিনা, সেটা দেখার বিষয়।
দুদকের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, এবারে ৪৩ জনের একটা তালিকা করা হয়েছিল। বুধবার তার মধ্যে থেকে ২২ জনের তালিকা বিমানবন্দরে গেছে। এই ২২ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে থেমে থেমে অভিযান চলবে। ধারণা করা যায়, যখন একবার শুরু হয়েছে, এটা বেশ কিছুদিন চলবে। তবে এই তালিকা কিসের ভিত্তিতে তৈরি হয়, সেই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। কখনো সন্দেহভাজন অপরাধীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বিশেষ কারণে তালিকা করার যে রাজনীতি, সেটা আবার রাজনীতিবিদরাই ভালো বলতে পারেন। যখন দেখা যায়, সংখ্যায় বেশি হয়ে গিয়েছে, তখন তালিকাভুক্ত হয়, অঙ্কটা এমন সোজা নয়।
১/১১তে ট্রুথ কমিশনে অনেকেই তাদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের বিবরণী দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তারা বিপদে পড়েছেন। কারণ আদালত সেই আইনের বৈধতা দেয়নি। পার্লামেন্ট আইন করতে যায়নি। অনেকে বলেন, যখন আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া হয় না, তখন তালিকা হয়। তালিকা একটা দেশের সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে না। বিশেষ অবস্থা নির্দেশক। দুর্নীতি দমনকে সব সময়ই একটা বিশেষ বিষয় হিসেবে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে। দুর্নীতি দমনের কথাগুলো বারংবার রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে যে চূড়ান্তভাবে সেটা অসার হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই তালিকাকরণ একটি উপাখ্যান। এটা আরো কিছুদিন চলবে। কেউ বলেছেন, এটা ১০০ পর্যন্ত উঠলেও অবাক হওয়ার থাকবে না।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, হঠাৎ করে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। হঠাৎ করে তালিকাবাজরা দুর্নীতিবাজ হননি। তারা হয়তো বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। আর সেই বিনিয়োগ সব সময় তার ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখতেও হয়েছে। এমনকি তালিকাভুক্তদের কেউ কেউ হয়তো নির্বাচনী ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নানাভাবে ভূমিকা রেখে এসেছেন। সুতরাং নানাভাবে বা অনিবার্যভাবেই এটা একটা অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন বয়ে আনবে।
তবে পর্যবেক্ষকরা তাকে স্বাগত জানান এই বলে যে, দুর্নীতিগ্রস্তরা যেভাবেই অর্থোপার্জন করুক না কেন, সেটা যদি কখনো জবাবদিহির সম্মুখীন হয়, আর তা যদি তারা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পরিণতি তাকে ভোগ করতেই হবে। এবং সেটা করাই উচিত। বৈষম্যমূলক বলে সাফাই হতে পারে না।
আইনের শাসনের মূল কথা হচ্ছে, সকলের প্রতি সমতা এবং আইন সমাজ ব্যবস্থা সবাইকে একই চোখে দেখবে। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতিবাজ এড়িয়ে থাকবেন। কিছু দুর্নীতিবাজ এর বিচার হবে, কখনো তারা জামিন পাবেন। কখনো পাবেন না। এটা রাজনৈতিক আবহাওয়া অনুযায়ী নির্ধারণ হবে। এই অবস্থাটি বাংলাদেশকে বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। তাকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বাধা তৈরি করেছে।
পিক এন্ড চুজ পলিসি পরিহাসে পরিণত হবে। সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তালিকাভুক্তদের বিষয়েও সমান সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা করবেন। অথচ অপরাধের কোনো তালিকা নেই। অপরাধ সংঘটন এবং তার শাস্তি কি নেয়া হবে, তা আইনে কখনো কোনো পরিস্থিতিতেই থামিয়ে রাখার কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেনি।
২২ জনের পরে আরো ডজন ডজন লোকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি এটাই প্রমাণ করে যে তাদের ব্যর্থতা কতখানি জমা হয়েছিল। যেখানে কারো কারো নাম বিমানবন্দরে পাঠাতে হয়। এই পলিটিক্সের ধূম্রজালে বাংলাদেশের রাজনীতি কবে কিভাবে বেরিয়ে আসবে, তা কারো জানা নেই।
এ ধরনের পরিস্থিতি মাঝে মাঝে একটুখানি নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা তৈরি করে। আবার অনেকেই সন্দিহান, এসব আইনের শাসনের শর্তপূরণ, এটা সুশাসনের শর্তপূরণ, এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন কিনা। কারণ আইনের শাসন তালিকাকরণ সমর্থন করে না।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ