এএসপি আনিসুলের মৃত্যু হাসপাতাল কর্মীদের পিটুনিতেই

প্রকাশিত: ১২:০০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১০, ২০২০

এএসপি আনিসুলের মৃত্যু হাসপাতাল কর্মীদের পিটুনিতেই

ডায়ালসিলেট ডেস্ক:: মানসিক সমস্যায় ভুগে চিকিৎসা নিতে রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম।  ফিরে এলেন লাশ হয়ে। পরিবারের অভিযোগ,  আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ওই হাসপাতালের স্টাফরা।  মাইন্ড এইড হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজেও তাকে শারীরিক নির্যাতনের আলামত পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, আনিসুল করিমকে কয়েকজন মিলে চিকিৎসার নামে এলোপাতাড়ি মারধর করেছে, এতেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট। তিনি ৩১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের আগে তিনি নেত্রকোনা জেলা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, র‌্যাব ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে দায়িত্ব পালন করেন।

আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল করিম জানান, পারিবারিক কলহের কারণে তার ভাই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে মাইন্ড এইড হাসপাতালে যান। কাউন্টারে যখন ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন, তখন মানসিক কয়েকজন কর্মচারী তাকে দোতলায় নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণ পর তাদের জানানো হয় আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। এর পর তারা তাকে দ্রুত হৃদ্‌রোগ ইন্সটিটিউটে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় ওই হাসপাতাল থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। মাইন্ড এইড হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ওই কক্ষের প্রবেশের আগে থেকে এএসপিকে টেনেহিঁচড়ে আনার চিত্র স্পষ্ট দেখা যায় এতে। ওই কক্ষের সিসিটিভি ক্যামেরার ১৩ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, সোমবার বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার আনিসুল করিমকে টানাহেঁচড়া করে হাসপাতালের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।। কাপড়ের টুকরো দিয়ে তার হাত বাঁধা হয়। আনিসুলকে হাসপাতালের ছয় কর্মচারী মিলে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। এর পর নীল পোশাক পরা আরও দুজন কর্মচারী তার পা চেপে ধরেন। এ সময় দুই কর্মচারী কনুই দিয়ে তাকে সজোরে আঘাত করছিলেন মাথা ও ঘাড়ের দিকে।

মারধরের ৪ মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপুড় করা হয়, তখন তার শরীর ছিল নিথর। হাসপাতালের একজন কর্মচারী তখন তার চোখেমুখে পানি ছুড়ে মারেন। এতেও আনিসুল সাড়াশব্দ করছিলেন না। তখন কর্মচারীরা কক্ষের মেঝে পরিষ্কার করেন। ৭ মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রোন পরা দুজন নারী ওই কক্ষে প্রবেশ করেন। দুই-তিন মিনিটের মধ্যে কক্ষের দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়। এর পর আনিসুলের বুকে পাম্প করেন সাদা অ্যাপ্রোন পরা এক নারী। এতেও তার কোনো নড়াচড়া নেই। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর হাসপাতাল স্টাফদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। একজনকে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করতে দেখা যায়।

পরে তাকে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নেয়া হয়। হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। হৃদ্‌রোগ ইন্সটিটিউটের খাতায় লেখা রয়েছে ‘ব্রট ডেড’, তথা হাসপাতালের আনার আগেই মৃত্যু হয়েছে।

আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল করিম জানান, তার ভাইয়ের রক্তচাপজনিত সমস্যা ছিল। হৃদ্‌রোগও ছিল। কিন্তু এ দুটির কোনোটিই প্রকট ছিল না। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটুনিতেই আনিসুলের মৃত্যু হয়েছে।

আদাবর থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) ফারুক মোল্লা জানান, আনিসুল করিম মানসিকভাবে একটু অসুস্থ থাকায় মাইন্ড এইড হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে গণমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তারা সংগ্রহ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে। আনিসুলের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমকে কয়েকজন মিলে চিকিৎসার নামে এলোপাতাড়ি মারধর করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রশিক্ষিত নয়, হাসপাতালের এমন কিছু স্টাফ আনিসুলকে চিকিৎসার নামে মারধর করেছে। এতে তিনি মারা যান। পুলিশ খবর পেয়ে বেলা দেড়টার দিকে লাশ উদ্ধার করে।

এ বিষয়ে মাইন্ড এইড হাসপাতালের সমন্বয়ক মো. ইমরান খান গণমাধ্যমকে বলেন, আনিসুল করিমকে জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউট থেকে তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খুব উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছিলেন। স্টাফদের মারধর করছিলেন। তাকে নিবৃত্ত করার জন্য ওই কক্ষটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, আনিসুলকে মারধর করা হয়েছিল। কেন মারা হলো—এ প্রশ্নের জবাবে ইমরান খান বলেন, তিনি তখন হাসপাতালে ছিলেন না। ময়নাতদন্তেই জানা যাবে কীভাবে মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে সোমবার বিকালে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. তানভির হাসনাত রবিন।

তিনি গণমাধ্যমকে জানান, সোমবার বিকালে ওই পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। তার ভিসেরাসহ হার্ড ও রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। ভিসেরার মধ্যে ছিল লিভার, কিডনি ও স্টোমাক। সেগুলো সবই পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে সেগুলোর পর্যালোচনা করে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেয়া হবে।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ