চলে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা- আলী যাকের

প্রকাশিত: ১২:২১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৮, ২০২০

চলে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা- আলী যাকের

ডায়ালসিলেট ডেস্কঃঃ রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় শেষ বিদায় নিলেন মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের। একাত্তরের এ শব্দসেনাকে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার সময় অশ্রুচোখে বন্ধু-স্বজন-সহকর্মীরাও জানিয়েছেন শেষ বিদায়। কি কঠিন বাস্তবতা! এই মানুষটি নাই হয়ে গেলেন চিরতরে!

যতো কথাই বলি না কেন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার মতো মানুষ প্রায় উধাও। এ বিশ্বাসের ভিত্তি যদি হয় মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা তবে তেমন মানুষ দুরবীন দিয়ে তাকলেও চোখে পড়ে না। সে বাস্তবতায় আলী যাকেরের মৃত্যু এক বিশাল ও ব্যাপক বেদনার বোঝা, যা আজীবন এ জাতিকে বইতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে কর্কট রোগের সাথে লড়াই করলেও তিনি হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচতেন। সর্বনাশা করোনাভাইরাস সেটাও হতে দিল না।

তাকে মঞ্চে দেখি সত্তর দশকের শেষদিকে। এরপর একের পর এক অসামান্য অভিনয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তারকা। খেয়াল করবেন, নায়কোচিত আদল কিংবা শারীরিক গঠন কোনটাই ছিল না তার। বাঙালির তুলায় শালপ্রাংশু এ মানুষটির সামনে যে কোনও অভিনেতাকে মনে হতো ছোটখাটো। দেওয়ান গাজীর কিসসা, সৎ মানুষের খোঁজে এবং পরবর্তীতে গ্যালিলিও। কি অসাধারণ একেকটা পারফর্মেন্স করেছেন!

আমরা সবাই জানি সত্যের দায়ে সত্য ভাষণের কারণে ‘গ্যালিলিও’-কে কি পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল। আলী যাকেরের অসাধারণ অভিনয় দেশজ বাস্তবতায় সে কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয় । বলাবাহুল্য তিনি তার জ্ঞান ও পাঠ থেকেই জানতেন কী এবং কোন চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন। আমার মতে, ওপার বাংলার উৎপল দত্ত কিংবা সে মাপের অভিনেতাদের সাথেই শুধু তুলনা চলে তার। আমরা মঞ্চ নাটকের এই দুর্দশার কালে ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ যেন ভুলে না যাই। চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো আর কাউকে এই চরিত্রে মানায়? না আর কারো দ্বারা তা সম্ভব?

আমার সাথে তার পরিচয় হবার কোনও কারণ ছিল না। আমাদের মতো লেখক বাংলাদেশে ভুরিভুরি। কিন্তু আলী যাকের মাত্র একজনই। মূলত সামাজিক মিডিয়ার কারণেই তার আনুকূল্য আর সমর্থন পেতে শুরু করি। দেশের বিখ্যাত লোকজন বিশেষত পত্রিকা মিডিয়ার মানুষের নাক এতো উঁচু যে সেখানে স্বর্গের বাতাসও ঢুকতে পারে না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি আমার একের পর এক লেখায় কমেন্ট করতেন। পরামর্শও দিতেন।

একবার আমি রবীন্দ্রনাথের সচিব সুলেখক ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছিলাম। অবাক করে দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, এই মানুষটিকে নিয়ে তিনি আরও জানতে চান। আমি যেন আরো লিখি। এমন উদারতা সম্পর্ককে নিকটতর করবে এটাই স্বাভাবিক।

তার বহুমুখী প্রতিভার একটি হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ নাটক বহুব্রীহি। যে নাটকে তার চরিত্র ছিল ভোলাভালা মামার। বোনের বাড়িতে থাকা শালাকে দেখলেই দুলাভাই তিরষ্কার করেন। মনে করেন বোকার হদ্দ। অথচ এই শালা ই বাংলাদেশের রাজাকার বিরোধী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লাগসই কথাটি তুলে দিয়েছিলেন মানুষের মুখে মুখে। আলী যাকেরের পোষা টিয়া পাখিই বিটিভির অচলায়তন ভেঙে প্রথম বলেছিল: তুই রাজাকার। এই কাহিনীও তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন।

কিন্তু আমার কাছে বিস্ময় তার মোটিভেশনাল একটি ভাষণ। বিজ্ঞাপন জগতের দিকপাল এই মানুষটি নব্য যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের জন্য যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা বাঙালির অমূল্য সম্পদ। সে কথামালায় স্পষ্ট রবীন্দ্রনাথ তাকে কতোটা প্রভাবিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া থেকে কোম্পানির বড় পদ গ্রহণ করার অভিজ্ঞতায় এভাবে রবীন্দ্রনাথকে কেউ মনে করে কিনা- আমার জানা নাই। যৌবনে দায়িত্ব নিতে তার ভীতি কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলছেন, যে কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন- সূর্যে অস্তমিত হবার আগে কে দায়িত্ব নেবে এই প্রশ্নে সবাই যখন নীরব তখন ছোট মাটির প্রদীপ বলেছিল- সে কহিল স্বামী / আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। আলী যাকের বলছেন, এ কথাতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল সেদিন।

যখন করোনাভাইরাস নিয়মিত আমাদের স্বজনদের কেড়ে নিচ্ছে, আমার কাছে রামায়নের সেই শ্লোকটিই আরও বাস্তব হয়ে উঠছে। সর্বহারা রাবণকে নিয়ে বলা হয়েছিল: এক লাখ পুত্র তার সোয়া লাখ নাতি/ একজনও না রহিল বংশে দিতে বাতি।

আমাদের সংস্কৃতি এভাবে অনাথ হতে হতে, দেউটি নিভতে নিভতে, আজ প্রায় অন্ধকারকেই সত্য করে তুলছে। আমার গর্ব আলী যাকের জন্মেছিলেন চট্টগ্রামে। জন্মেছিলেন- আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে। আমরা ধৈর্য ধরবো দু:সময়ে। কবিতার সেই লাইনগুলো স্মরণ করি-

আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,

আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়

দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?

আলী যাকের আপনি আবার আসবেন এই ভাটি বাংলায় ।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ