প্রতারক চক্রের ফাঁদ: নিঃস্ব ১২ হাজার কুলি

প্রকাশিত: ১০:০৫ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৯, ২০২০

প্রতারক চক্রের ফাঁদ: নিঃস্ব ১২ হাজার কুলি

ডায়ালসিলেট ডেস্ক::একটি সমিতির অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পর খোলা হয় আরেকটি। বছর ঘোরার আগে সেটাও রাতারাতি গায়েব। কিছু দিন পর ভিন্ন নামে আরেকটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এভাবেই সমবায় সমিতির ফাঁদে ফেলে কয়েক হাজার শ্রমজীবী মানুষের যৎসামান্য সঞ্চয় হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী প্রতারক চক্র। কাওরানবাজারের কুলি, মিনতি থেকে শুরু করে ফুটপাতের মুদি দোকানি কেউই বাদ যায়নি। এমনকি ভিক্ষুকের জমানো অর্থ আত্মসাতে প্রতারকদের হাত এতটুকুও কাঁপেনি। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে অন্তত ১২ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ শেষ সঞ্চয়টুকু হারিয়ে এখন নিঃস্ব। ভিন্ন ভিন্ন নামের অন্তত চারটি নামসর্বস্ব সমবায় সমিতি খোলা হয়। এসব সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা। সমিতির নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়া প্রতারক চক্রের প্রধান হোতা আমীর হোসেন নামের এক পাতি রাজনৈতিক নেতা। তিনি রাজধানীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি। এখন জেলে। তবে সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তাকে জেলে যেতে হয়নি। ইয়াবা বিক্রির সময় অস্ত্রসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হন আমীর হোসেন। প্রতারণার ঢাল রাজনৈতিক পদবি : দলীয় পদ থাকায় আমীর হোসেন একের পর এক প্রতারণা করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। অথচ রাজনীতিতে নাম লেখানোর আগে তিনি পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভার ছিলেন। নিয়মিত ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে পণ্য পরিবহনের কাজ করতেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন তেজগাঁও র‌্যাংগস গলিতে টিনের ঝুপড়ি ঘরে। এক সময় যুবদলের মিছিল মিটিংয়ে যেতেন নিয়মিত। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে সরকারি দলে ভিড়ে যান তিনি। টুকটাক রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে যাওয়ার সুবাদে স্থানীয় ওয়ার্ড নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। কাওরানবাজারের কুলি, মিনতিসহ ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে সমবায় সমিতির ফাঁদ পাতেন তিনি। ২০১০ সালে খোলেন শুভেচ্ছা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। চটকদার প্রলোভনে শ্রমজীবীদের অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দ্রুততম সময়ে সদস্য সংখ্যা ছয় হাজার পেরিয়ে যায়। কিন্তু ২০১৪ সালে একদিন হঠাৎ সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। ম্যানেজার টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছে বলে লোপাট করা হয় হতদরিদ্র মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই নতুন আরেকটি সমিতির সাইনবোর্ড লাগায় প্রতারকরা। এবার নাম দেয়া হয় মেহনতি সঞ্চয় এবং ঋণদান সমবায় সমিতি। বর্তমানে মেহনতি সঞ্চয় নামের সমিতির কার্যক্রম চলছে আমীর হোসেনের তেজগাঁওয়ের বাড়িতে। জমানো টাকার দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ ফেরতের নামে সদস্যদের প্রলুব্ধ করা হয়। ৫০ হাজার টাকা জমা করতে পারলে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ এবং পাঁচ লাখ টাকা জমা করতে পারলে ২০ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেন প্রতারকরা। ১১ শতাংশ সুদ অর্থাৎ এক লাখ টাকায় মাসে ১১ হাজার টাকা সুদ ধরে প্রথম দিকে কয়েকজনকে ঋণ দেয়া হয়। এরপর ঋণ দেয়ার শত শত প্রস্তাব পেন্ডিং রেখে শুধু সঞ্চয়ের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ধান্ধায় ব্যস্ত ছিল চক্রটি। ড্রাইভার থেকে কোটিপতি : প্রতারণার অর্থে রীতিমত কোটিপতি বনে যান আমীর হোসেন। একসময়ের পেশাদার গাড়িচালক বর্তমানে ১৯টি ট্রাকের মালিক। তার পরিবহন কোম্পানির বহরে আছে অশোক লে-ল্যান্ড এবং আইচার মডেলের একাধিক মূল্যবান ট্রাক। এসব ট্রাকের প্রতিটির মূল্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগ আছে তার। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ৪১৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে রেলের জমিতে অবৈধভাবে একটি চারতলা এবং একটি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৪১৬/১৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে জুুঁই রেস্তোরাঁর মালিক আমীর হোসেন। ২৪ ডিসেম্বর সরেজমিন আমীর হোসেনের ছয়তলা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়িটি দুই ইউনিটের। প্রতি ইউনিটে দুটি ঘর, লাগোয়া বাথরুম এবং রান্নাঘর। আমীর হোসেনের ম্যানেজার মামুন বলেন, ছয়তলা ভবনের দু’কক্ষের ভাড়া ছয় হাজার টাকা। মামুন জানান, পাশেই তাদের আরেকটি চারতলা ভবন রয়েছে। সেখানে দু’কক্ষবিশিষ্ট ফ্ল্যাটের ভাড়া ১২ হাজার টাকা। দুটি বহুতল ভবন ছাড়াও টিনের অসংখ্য ঘর তুলে ভাড়া দেয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, তেজগাঁওয়ের র‌্যাংগস এবং বিজি প্রেসের গলিতে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন আমীর হোসেন। ট্রাকপ্রতি ঘণ্টা হিসাবে চাঁদা নেয়া হয়। একদিন বা ২৪ ঘণ্টার জন্য ট্রাকপ্রতি চাঁদা ২০০ টাকা। প্রতি রাতে শুধু এই দুটি গলিতেই ট্রাক থাকে শতাধিক। সে হিসাবে ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে প্রতি মাসে আমীরের চাঁদা ওঠে প্রায় ১২ লাখ টাকা। চাঁদার ভাগ পান শিল্পাঞ্চল থানার কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা। শিল্পাঞ্চল থানার সাবেক দারোগা ফরিদ ছিলেন তার ডান হাত। ফরিদের বাড়িতে তিনি ফ্রিজ, টিভিসহ বিভিন্ন উপহার দেন। হাহাকার : সরেজমিন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তেজগাঁও, বেগুনবাড়ি, শিল্পাঞ্চল ও নাখালপাড়া এলাকার হকার, হোটেল বয়, নাপিত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং ফুটপাতের দোকানদার থেকে শুরু করে নিুপদের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মচারী প্রতারিত হন। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন টিউবসের ইলেকট্রেশিয়ান ফরিদ আলমের পাওনা চার লাখ ৪০০ টাকা। এর মধ্যে নানা দেনদরবার করে কয়েক কিস্তিতে এক লাখ টাকা ফেরৎ পান। বাকি টাকা এখনও উদ্ধার হয়নি। যুগান্তরের কাছে অর্থ আত্মসাতের বর্ণনা দিয়ে ফরিদ অঝোরে কাঁদেন। বলেন, ‘টাকাগুলো আত্মসাৎ হয়েছে শুনে আমার বাবা স্ট্রোক করেন। কিন্তু অর্থাভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারিনি। চিকিৎসা না পেয়ে তিনি মারা গেছেন। বর্তমানে আমার মা স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছেন। অথচ আমার এতগুলো টাকা সমিতির লোকজন হাতিয়ে নিল! টাকা হারিয়ে আমি অনেক ছোটাছুটি করেছি। কিন্তু ওরা প্রভাবশালী। শেষ পর্যন্ত তাদের কিছুই করতে পারিনি।’ তেজগাঁও র‌্যাংসের গলিতে ব্যাটারির দোকান চালান রংপুরের বাসিন্দা মজনু। তিনি বলেন, ‘আমি দুটি সদস্য বই নিয়েছিলাম। বলেছিল একটি বইয়ে ৭৫ হাজার টাকা জমা হলে এক লাখ টাকা দেবে। আমার একটি বইয়ের মধ্যে ৫৩ হাজার টাকা হয়েছিল, আরেকটি বইয়ে ১১ হাজার। একটি টাকাও ফেরৎ পাইনি। এছাড়া আমি আরও পাঁচজনকে সদস্য করেছিলাম। তারাও সর্বস্বান্ত হয়েছে।’ তেজগাঁওয়ের ফুটপাতে খুচরা চাল বিক্রেতা কামাল হোসেন সন্তানদের পড়ালেখা করাবেন বলে সমিতিতে ৫০/১০০ টাকা করে প্রায় ৮১ হাজার টাকা জমা করেন। কিন্তু একটি টাকাও তিনি ফেরৎ পাননি। কামাল বলেন, ‘কষ্টের ট্যাকাগুলো হারাইয়া অনেক ঘুরছি, থানায় জিডি পর্যন্ত করছি। কিন্তু থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জিডির তদন্ত করব বইল্যা থানা থেইক্কা একজন দারোগা আইছিল। আমীরের অফিসে বইস্যা ঠাণ্ডা খাইয়া গেল গা। আর আহেনাই। ট্যাক্যাও পায়নি।’ জানা যায়, ভুক্তভোগীদের অনেকে টাকা ফেরত চেয়ে মারধরের শিকার হন। তাদের একজন ফেনীর বাসিন্দা নাসির উদ্দিন। তেজগাঁওয়ে ফুটপাতে চা-পান-বিড়ির দোকান তার। নাসিরের খোয়া গেছে প্রায় এক লাখ টাকা। ভুক্তভোগী নাসির যুগান্তরকে বলেন, ‘তেজগাঁওয়ে দোকান চালাই ৩০ বছরের বেশি। আমীরের বাড়িঘর সবই এইখানে। তিনি রাজনৈতিক নেতা। সবাই সম্মান করে। সবকিছু দেখে শুনে তার হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলাম। কে জানত তিনি টাকা মেরে দিবেন। টাকা ফেরত চাওয়ায় আমীরের লোকজনের হাতে মাইরও খাইছি।’ হাত দিয়ে কিছুটা দূরে একটা ভবনের পাশের ফুটপাত দেখিয়ে নাসির বলেন, ওই যে, ওইখানে স্বপন নামের একজনের সেলুন আছিল। শুভেচ্ছা সমিতিতে স্বপন ২৮ হাজার টাকা জমা দেয়। কিন্তু একটা টাকাও ফেরত পায়নি। টাকার শোকে দুঃখে লোকটা মইর‌্যা গেছে।’ ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানা পুলিশের দরজায় ঘুরে ঘুরে টাকা ফেরতের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকের সঞ্চয় বই হারিয়ে গেছে। অনেক সদস্য ইতোমধ্যে মারা গেছেন। এছাড়া পুলিশের সহায়তায় বেশ কয়েকজন পাওনাদারকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হয়। আমীর হোসেনের শুভেচ্ছা সমবায় সমিতির সাবেক ম্যানেজার এসএম সেলিম সোমবার সন্ধ্যায় বলেন, শুভেচ্ছা সমীতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে তিনি চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তবে বর্তমানে আমীর হোসেনের মালিকানাধীন মেহনতি সমবায় সমিতিতে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুভেচ্ছা সমিতিতে আমীর হোসেন ছাড়াও নজরুল ইসলাম নামের এক বিএনপি নেতার মালিকানা ছিল। টাকা পয়সা আত্মসাৎ করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। এ কারণে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। থানা পুলিশের ৩ নম্বর বিট থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিল্পাঞ্চল থানার ওসি বিপ্লব কুমার সীল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এ থানায় নতুন যোগদান করেছি। ফলে অভিযোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত আমি জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে দেখব, যদি প্রমাণ পাওয়া যায় তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

0Shares