ওসমানি মেডিকেল যেন জুয়ার স্বর্গরাজ্য, চলছে রমরমা ব্যবসা

প্রকাশিত: ৩:৪২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০২১

ওসমানি মেডিকেল যেন জুয়ার স্বর্গরাজ্য, চলছে রমরমা ব্যবসা

সোহেল আহমদ ::

সিলেট নগরীর ওসমানী মেডিকেল রোড এলাকা যেন এখন জুয়ার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।  তীর শিলং এবং আইপিএল এ দুটি  জুয়া খেলায়  চলছে  রমরমা ব্যবসা। অনেকেই জুয়া খেলার ভাগ পেয়ে চুপচাপ বসে আছেন যেন ” তারা নিজেরা ধূয়া তুলসী পাতা”। নগরীর ওসমানি মেডিকেলে এলাকায় এবং লালা দিঘীরপাড় এলাকায় এভাবেই প্রকাশ্যে তীর শিলং জুয়ার বোর্ড বসিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা কার্যক্রম। এর ফলে স্থানীয় এলাকার  স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও বেকার যুবকরা আসক্ত হচ্ছেন জুয়া খেলার প্রতি।

 

এদিকে, ভারতের  ক্রিকেট বিশ্বের বড় আসর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) ঝমকালো আয়োজনে একটা নির্দিষ্ট অংকের বাজি (জুয়া) ধরে  আসরটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদনই বসছে জমজমাট জুয়ায় আসর। নগরীর ওসমানি মেডিকেল হাসপাতালের ইমাজেন্সী গেইটে সন্ধ্যা হলেই দেখা যায় যুবকদের আড্ডা । ঠিক একই অবস্থান ওসমানি মেডিকেল কলেজ  গেইটে এ। সেখানেও চায়ের দোকানে বসে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে আইপিএল খেলার বেট ধরে খেলছেন অনেকেই।

 

প্রতিদিন বিকেল হলেই শুরু হয় তীর শিলং ব্যবসার বাজিমাত আবার সন্ধ্যা হলে শুরু হয় আইপিএল খেলায় জুয়ার আসর। পুড়োও এলাকা যেন বসেছে ক্যাসিননো খেলার আসর। দেখার মত কেউই নেই। আবার মেডিকেল কলেজ গেইট এলাকায় সন্ধ্যায় তরুণরা আড্ডা জমান পানের দোকান ও চায়ের দোকানগুলোতে ।

 

সিগারেটের সাথে চায়ের আড্ডায়  আইপিএল জুয়া খেলায় মেতে উঠে তারা। এসময় মোবাইল ফোনে আইপিএলে বেট ধরে জুয়া খেলে সময় পাড় করে। বাজির নামে এ জুয়া খেলায় নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই। যাদের বেশিরভাগই হচ্ছে তরুণ যুবক।

 

অন্যদিকে,  সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয় এলাকায় তীর শিলং এবং আইপিএল  খেলায় আসক্ত হওয়া বেশীরভাগ  ২০ – ৩০ বছর বয়সের যুবক, যার হার ৫০ শতাংশ এদের মধ্যে বেশিরভাগই স্কুল ও কলেজের ছাত্র ও যুবক। বাকি ২০ শতাংশ নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত আয়ের  মানুষ এবং ৩০ শতাংশ ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ক্লিনিক ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে থাকা ডিউটিরত কর্মচারী যুবকরা।

 

জানা যায়, তীর শিলং নামের জুয়া খেলাটি সপ্তাহে ৫দিন বেট ধরা হয়। তার মধ্যে দিনের তীর শিলংটি এফআর নামে বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা  এবং এসআর নামে সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পযর্ন্ত বেট ধরা হয়।  আবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা এফআর এবং সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার খেলাটি এসআর নামে পরিচিত। আর বিশেষ করে রাতের খেলাটি সবার কাছে ” তীর নাইট শিলং “ খেলা নামে সুপরিচিত।

 

এ খেলার নিয়ম সর্বনিম্ন ৫টাকা থেকে শুরু করে হাজারের উপরে বেট ধার হয়। আর এসব খেলা বেশীর ভাগই সামজের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত  লোকদের  সারাদিনের উপার্জনের টাকা দিয়ে জুয়া খেলতে আসে । পরে অনেককে জুয়া খেলায়  খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয়।

 

নগরীর শেখঘাট, ওসমানি মেডিকেল হাসপাতাল (১নং গেইট থেকে ৩নং গেইট) এলাকা, বিশেষ করে লালাদিঘীর পাড় , কাজিরবাজার, মহাজনপট্টির, মেথরপট্টি, ছড়ারপার, কালিঘাট পিয়াজপট্টি , লামাবাজার, বাগবাড়ি, কানিশাইল-সহ বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে তীরশিলং বোর্ড এবং আইপিএল জুয়ার ভ্রাম্যমাণ আসর। এসব তীর খেলায় যারা পরিচালনা করেন তাদের অনেককেই দেখা যায় এই জুয়ার বোর্ড থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে অনেকে গড়েছেন দালান-কোঠা,বাড়ি গাড়ি এমনকি জমির মালিকও হয়েছেন।

 

এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওসমানি মেডিকেল এলাকার স্থানীয় এক ব্যবসায়ী ডায়ালসিলেটকে জানান, নগরীর লালাদিঘীরপার ভাতালিয়া, বাগবাড়ি ও ওসমানি মেডিকেল এলাকার রুবেল , শাহজাহান, শিবলু নামে কয়েকজন এজেন্ট  তীর শিলং জুয়ার খেলাটি নিয়ন্ত্রন করেন। আর পুলিশের কর্মকর্তা  জামাল আহমদ নামে একজন ব্যক্তি দুদিন পরপর ঐ এলাকায় এসে বোর্ড থেকে ভাগের অংশ নেন। তবে পরিচয় এখনো জানিনা।শুধু দেখি আসে আর পকেটে করে টাকা নিতে দেখি আর কিছু জানি না।

 

এ বিষয়ে  লালাদিঘীর পাড় এলাকায় তীরশিলং বোর্ডের কথা অস্বীকার করে স্থানীয়  ১১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম ঝলক ডায়ালসিলেটকে বলেন, লালাদিঘীরপারে কোন জুয়া খেলা হয়না। ভাতালিয়া ডাবতলা এলাকায় জুয়া খেলা হতে পারে। তবে লালাদিঘীরপার এলাকায় হয় না এটা বলতে পারি। আপনারা সরেজমিনে এসে দেখে যান আপনাদের সাথে নিয়ে প্রয়োজনে ঘুরে দেখাবো। এরকম পেলে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেন এতে আমরা আপনাদের সমর্থন দেবো। তিনি বলেন, আমি যখনই এলাকায় ১০-১২জন লোক একসাথে দলবদ্ধ হয়ে কাউকে আড্ডা দিতে দেখি সাথে সাথে লামাবাজার পুলিশ ফাড়িতে ফোন করি যাতে এলাকায় কেউ অযথা আড্ডা না দেয়।

 

সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ওসমানি মেডিকেলের গেইটগুলোর কয়েকটি  দোকানে, ইন্টারনেট, ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ব্যবসা চালায় এবং লালাদিঘীর পাড় এলাকায় পুকুরের পাশে মনিপুরী গল্লিতে মাঠের সামনে দোকান ও হোটেলগুলোতে প্রতিদিনই চলছে তীর শিলং জুয়ার বোর্ডের রমরমা ব্যবসা। আর এসব তীরের বোর্ড নিয়ন্ত্রণদাতা কয়েকজনের  মাধ্যম হয়ে মেডিকেল, বাগবাড়ি, কাজলশাহ  এবং লালাদিঘীরপার এলাকায় আরো বেশ কয়েকজন  তীরের এজেন্ট হিসেবে কাজ পরিচালনা করছেন। এই তীরশিলং বোর্ডে  ৮ থেকে ১০ জনের টিম/এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারাই বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে খেলার টাকা কালেকশন করে।

 

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী স্থানীয় এলাকা মুরব্বীর মজিদ মিয়ার সাথে কথা বললে তিনি ডায়ালসিলেটকে জানান, এসব কিছুর মধ্যে এলাকার স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী  নেতাদের ছত্রছায়ায়  ঘটনাটি ঘটে। তাদেরকে টাকা দিয়ে জুয়া খেলা তীর শিলং বোর্ডের কাযক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এজেন্টরা। তাই উধ্বতর পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।  এলাকায় এই অবস্থায় চলতে থাকলে আমরা আমাদের এলাকায় থাকা যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। টাকার বিনিময়ে দেখা যাবে ভাল ছেলেরা চুরি, ছিনতাই এমনকি মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়ে সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা  অনেক চেষ্টা করেছি জুয়ার বোর্ড সরানোর জন্য পরে  কিছু ছেলেরা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঐ এলাকায় বোর্ড বসিয়ে জুয়ার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা কোন দেশে বাস করছি। সরকার বা পুলিশ ও র‌্যাবের উধ্বতর কর্মকর্তা যদি এ বিষয়টি খতিয়ে না দেখেন তাহলে চোখের সামনে এভাবেই নীরবে বসে যুবকরা ধ্বংস হতে দেখতে হবে আমাদের।

 

এছাড়াও নগরীর অণ্যান্য এলাকা যেমন- ছড়ারপাড় ,কালীঘাট এলাকার পিয়াজপট্টি এলাকার , মাছিমপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, পাড়া-মহল্লার দোকানে তীরের খেলা চলে। বিশেষ করে ছড়ারপাড় এলাকায় সবজি বাজারের পিছনে নাছিম নামে একজন এবং কালিঘাট এলাকার পিয়াজপট্টি এলাকায় শরিফ নামের এক যুবকের নিয়ন্ত্রণে তীর শিলং বোর্ড এর ব্যাবসা চালানো হয়। আর এসব পরিচালনার জন্য প্রভাবশালী নেতাদের কমপ্রোমাইজ করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

 

এব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া বিএম আশরাফ  ডায়ালসিলেটকে বলেন, আমি এই বিষয়টি জানতাম না আপনার মাধ্যমে জেনেছি তবে আমরা আশ্বস্থ করছি এসব কার্যকলাপে যেই জড়িত থাকুক না কেন তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আমরা এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।

 

গত কয়েকমাস পূর্বে সিলেটে ‘তীরশিলং’ নামে জুয়া খেলায় র‌্যাব-৯ এর বিশেষ অভিযানে  কিছুটা সস্তি থাকলেও। সম্প্রতি এই খেলাগুলো আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধারণা করা হয় সিলেটে তীরশিলং জুয়াতে সব মিলিয়ে প্রতিদিন কোটি টাকার বাজি ধরা হয়। এমন জমজমাট খেলার বাজিমাত আইপিএলকে ঘিরে এই বাজিতে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হচ্ছে সিলেটে।এই খেলায় মূলত, এজেন্টরা তাদের মোবাইল ফোন ইন্টারনেটের মাধ্যমে  ডিজিটাল পদ্ধতিতে তীর শিলং এবং আইপিএল জুয়াখেলার আসর চালিয়ে যাচ্ছে।  এতে ধ্বংস হচ্ছে যুবসমাজ। ভারতে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

 

এবিষয়ে র‌্যাব-৯ এর মিডিয়া অফিসার এএসপি ওবাইন ডায়ালসিলেটকে বলেন, তীর শিলং জুয়া খেলার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরকম কোথাও যদি সংবাদ পাই তাহলে  জুয়া খেলায় এজেন্টদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

 

উল্লেখ্য, অনেক নিম্নবিত্ত (লেবার, শ্রমিক), মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা তীর শিলং জুয়া খেলে দ্বিগুন টাকা লাভের আশায়  বেট ধরে হেরে আবার সেই চলে যাওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় আবার জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে অভ্যাসে পরিনত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয় ঋণের বুঝা মাথায় রেখে অবশেষে বাড়ির জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে পথে বসতে বসেছে অনেকেই। এমতাবস্থায়  এলাকায় স্থানীয়দের একটাই দাবি যুব সমাজকে বাচাতে অনতিবিলম্বে তীর শিলং এবং আইপিএল  জুয়া খেলা বন্ধ করতে প্রশাসনের নিকট সহযোগিতা চেয়েছেন।

 

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ