‘কলুষিত’ ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি

প্রকাশিত: ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০২১

‘কলুষিত’ ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি

ডায়ালসিলেট ডেস্ক::১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সাফল্যে লেখা হয় ছাত্র আন্দোলনের গৌরবগাথা। সেই থেকে নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি দেশের স্বাধিকার, গণতন্ত্র ও জনমুক্তির সব আন্দোলনে আছে ছাত্রদের উজ্জ্বল ভূমিকা। সেসব ক্যাম্পাসেই ছাত্ররাজনীতির আলোকছটা ম্লান হওয়ার পথে।

সেখানে একই সংগঠনের প্রতিপক্ষের কর্মীদের ওপর চলছে নির্যাতন। ঘটছে হত্যাকাণ্ড। বুয়েটে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যায় আরও ২৫ প্রাণ ও তাদের পরিবারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে। এসবই কি বর্তমান কলুষিত ছাত্ররাজনীতির কুফল, না পথহারা রাজনীতির নেতিবাচক লক্ষণ?

রোববার  আলাপকালে এ নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন ডাকসুর সাবেক তিন ভিপি-

ছাত্ররাজনীতিতে পচন ধরেছে: রাশেদ খান মেনন

ডাকসুর সাবেক ভিপি রাশেদ খান মেনন বলেন, মূলত নব্বই পরবর্তীকালে ছাত্ররাজনীতিতে অবক্ষয় শুরু হয়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলো সেই থেকে রাজনৈতিক দলের অধিভুক্ত হয়ে দল-দাসে রূপান্তরিত হয়েছে। যার ফলে ছাত্ররাজনীতির প্রকৃত রূপ ও জৌলুস হারিয়ে গেছে। কাক্সিক্ষত নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, নিষ্ঠা প্রস্থান করেছে।

বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে ছাত্ররাজনীতিতে পচন ধরেছে। আজকে খুব কম সংগঠনই ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলে। এর প্রমাণ হচ্ছে, সর্বশেষ বাসে হাফ পাশের আন্দোলন। এতে কোনো প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন নেই। হয়তো বিবৃতি দিয়ে সহানুভূতি দেখিয়েছে কেউ কেউ।

কিন্তু কার্যত এখানে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিরেট সাধারণ ছাত্ররা মাঠে নেমেছে। বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতি এবং এর অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যুগান্তরের সম্পর্কে আলাপকালে এসব কথা বলেছেন তিনি।

রাশেদ খান মেনন ১৯৬৩-৬৪ সেশনে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী।

সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠিত কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব চোখে পড়েনি। আবার চোখের সামনে দেখলাম- আবরার হত্যার ঘটনা কীভাবে ঘটেছে। যদিও অনেক ছাত্রের ফাঁসি হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির কতটা পচন ধরেছে, সেটাই এই ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে।

যুগান্তরের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের কাছে কোনো সুপারিশ করে লাভ নেই। ছাত্রদের যে অধিকারগুলো রয়েছে, তা দিয়ে দেওয়া উচিত। গণতান্ত্রিক অধিকার, শিক্ষার অধিকার এসব সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে। প্রশাসন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে কোন লাভ নেই, সেটা সঠিক হবে না।

ছাত্র সংগঠনগুলোকে বলব- রাজনীতি করতে হলে স্বাধীন সত্তার ভিত্তিতে রাজনীতি করতে হবে। কোনো বিশেষ দলের দল-দাস হয়ে নয়। বরং সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে। সাধারণ ছাত্রদের দাবি নিয়ে তাদের মুখ্য বিষয়টি নিয়ে সামনে আসতে হবে। জাতীয় রাজনীতির প্রশ্ন আসবে। কিন্তু কোনো দলের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাধীন ছাত্ররাজনীতি হতে পারে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নেই: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন, ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন যা চলছে, সেটা আসলে ছাত্ররাজনীতি নয়। বুয়েটে আবরার ফাহাদের যে ঘটনা, কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যে অরাজকতা চলছে তা ছাত্ররাজনীতির কারণে নয়।

মূলত ছাত্ররাজনীতি না থাকার কারণেই এসব ঘটছে। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারের মাস্তান বাহিনীর বিস্তার, দখলবাজি ও গ্যাংস্টার সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছে। এটা ছাত্রদের রাজনীতি গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে।

১৯৭২-১৯৭৩ মেয়াদে ডাকসুর সহ-সভাপতির (ভিপি) দায়িত্ব পালন করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। বৃহস্পতিবার যুগান্তরের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়।

তিনি বলেন, এটা থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে, ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশপ্রেমের চর্চাকে অবাধ করে দিতে হবে। প্রতিবছর নির্ধারিত দিনে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। বুয়েটে আবরার ফাহাদের ঘটনাটি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার সময়েই ঘটেছে। যদি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেমের চর্চা থাকত তাহলে হয়তো এই ঘটনা ঘটত না।

দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে যদি ক্যাডার, হোন্ডা আর গুন্ডা বাহিনী সাধারণ ছাত্রদের ওপর কর্তৃক ও জোরজবরদস্তি করে তাহলে সেখানকার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। যদিও এটা ছাত্রদের খুবই একটা ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু তারা বড় ধরনের ক্ষতি করছে।

তিনি এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ক্যাম্পাসের মোট শিক্ষার্থীর ৯০ ভাগের বেশিই সাধারণ হিসাবে পরিচিত, যারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তারা যেন নির্ভয়ে আত্মশক্তি নিয়ে জেগে ওঠে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই জাগরণে ক্যাম্পাসে দিনে দিনে জমে ওঠা আবর্জনা পরিষ্কার হবে। পাশাপাশি তারা সুস্থ ধারা ও প্রকৃত দেশপ্রেমের রাজনীতির চর্চায় যুক্ত হতে পারে। ক্যাম্পাসে এখনো বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সেই রাজনীতির চর্চা চলছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তারা তা জাগিয়ে রেখেছে।

ক্যাম্পাসে চলছে মাস্তানি চর্চা: মাহমুদুর রহমান মান্না

ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আসলে এখন ছাত্ররাজনীতি নেই। বর্তমান ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনের নামে আদর্শবিহীন মাস্তানি চর্চা চলছে। ছাত্ররাজনীতিকে বিপথগামী করতে যা যা প্রয়োজন তার সবই করছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন।

বুয়েট থেকে এখন সবার শেখা উচিত। ছাত্ররা যদি এখনো মনে করে, সরকারি দলে থাকলে সুবিধা পাওয়া যাবে-তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। অন্যদিকে মূল ধারার ছাত্রসংগঠনগুলো যদি মনে করে তাদের ছাড়া কোনো আন্দোলন হবে না, তবে সেটাও চরম চরম ভুল।

এর প্রমাণ হচ্ছে সাম্প্রতিক হাফ ভাড়া আন্দোলন। এছাড়া নিরাপদ সড়ক ও কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রমাণ করেছে বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতি সঠিক ধারায় নেই। বিপরীত দিকে তাদের ছাড়াও যে ছাত্র আন্দোলন হতে পারে সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। আরও প্রতীয়মান হয়েছে, কোনো সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই ছাত্ররা অধিকার আদায় করতে পারে। তারাই অধিকার আদায় ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভ্যানগার্ড।

কেউ নেতৃত্বে আসুক বা না আসুক প্রয়োজন অবধারিত হলে আন্দোলন ফুঁসে উঠবেই। বুয়েটের আবরার হত্যা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আরও ২৫ মেধাবী ছাত্রের খুনি হিসাবে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেছেন তিনি।

মান্না বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি। তিনি ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে দুই মেয়াদে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) ছিলেন।

সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, বুয়েটে আবরার হত্যার মতো এমন বর্বর ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এর আগে কখনো ঘটেনি। আবার যে ২০ জনের ফাঁসি হলো, তারাও দেশের সেরা মেধাবীদের কাতারে আছে। চোখ বন্ধ করে ওদের বাবা-মায়ের এখনকার অবস্থা কি ভাবা যায়? তারা তো তাদের সন্তানদেরকে রাজনীতি করতে পাঠায়নি। এদেরকে রাজনীতিতে এনেছে ছাত্রলীগ। এর দায় কি এখন এই সংগঠনটি এড়াতে পারে? শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, গত ১৩ বছরে এই দেশে ছাত্রদের দিয়ে যত গুন্ডামি হয়েছে সবই করিয়েছে ছাত্রলীগ। এক ধরনের আদর্শবিহীন, মাস্তানি চর্চা সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে।

তিনি বলেন, হলগুলোতে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। প্রশাসনকে উপেক্ষা করে শাসক দলের ছাত্রনেতারা হল পরিচালনা ও সিট বণ্টন করে। ফলে গ্রাম থেকে আসা গরিব সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কেবল ঢাকায় থাকার জন্য শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করছে। তাদের হাত থেকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত রক্ষা পাচ্ছে না।

বিভিন্ন সময়ে অনেককে পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে দেওয়া হয়নি। মোট কথা, চর দখলের মতো হল দখল করে রেখেছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা নির্যাতিত হচ্ছে, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত দিচ্ছে। শিক্ষকদেরও ভয়ানক পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ কুয়েটের সাম্প্রতিক ঘটনা। ছাত্রনেতাদের বিপথে যাওয়ার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত প্রশাসনের দায়ও কম নয়।

তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে ক্যাম্পাস সুরক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু পরিত্রানের উপায় সরকারের কাছে চেয়ে কি কোনো লাভ হবে। যদি তা না হয়, তাহলে দেশের ছাত্রসমাজকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেভাবে হাফ পাশ, নিরাপদ সড়ক আর কোটা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে বিদ্রোহ করেছে। আমি বলব, বিদ্রোহ করলে তোমাদের জয় হবেই।

ডায়ালসিলেট এম/

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ