প্রকাশিত: ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০২২
ডায়াল সিলেট ডেস্ক :: বিশ্বের যে দেশগুলো ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহার করে থাকে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহার কীভাবে বন্যা প্রবণতা কমাতে ভূমিকা রাখে সেই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি নিউ সায়েন্টিস্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক কাজী মতিন আহমেদ ও তাঁর সহকর্মীরা গবেষণাটি করেছেন। এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের কৃষকেরা সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন প্রধানত ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়ছে, সেই সঙ্গে বর্ষাকালে বন্যা হ্রাসেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। মূলত অতি পরিমানে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। গ্রীষ্মকালে পানির স্তর অনেকটা নিচে নেমে গেলেও বর্ষাকালে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেকখানি নেমে যাওয়ার পর বর্ষাকালে প্রবল বর্ষণে ভূ-উপরিস্থ বিপুল পানি ভৌম-জলাধার বা জলবাহীস্তরে চলে যায়। এতে বৃষ্টির ফলে জমে যাওয়া অতিরিক্ত পানি শোষিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি প্রশমিত করে।
উল্লেখ্য, অ্যাকুইফার, বাংলায় ভৌম-জলাধার বা জলবাহীস্তর হলো—ভূগর্ভের একটি স্তর যেখানে থাকে পানি ধারণে সক্ষম প্রবেশ্য শিলা, শিলাখণ্ড অথবা অসংহত বস্তু। কোনো প্রবেশ্য শিলাস্তরের নিচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর অবস্থান করলে, ওই প্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্য দিয়ে বৃষ্টির পানি অপ্রবেশ্য শিলাস্তরে পৌঁছার পর পানির নিম্নগতি বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওপরের প্রবেশ্য শিলাস্তরটি পানি ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবং সম্পৃক্ত হয়। এই পানি ধারণকারী প্রবেশ্য শিলাস্তরকে অ্যাকুইফার বলে। এই স্তুর থেকেই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়।
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এবং কৃষিক্ষেত্রে অন্যান্য উন্নয়নের ফলে ১৯৮০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারছে এবং খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক কাজী মতিন আহমেদ নিউ সায়েন্টিস্টকে বলেন, ‘সেচ কাজে বাংলাদেশ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে ভূগর্ভস্থ পানি রয়েছে। তবে এটির সংকট শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের ৪৬৫টি স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক নমুনা সংগ্রহ করে ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৬০ লাখ কৃষক কী পরিমান ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেছেন সেটির একটি ধারণা পেয়েছেন কাজী মতিন ও তাঁর সহকর্মীরা। শুষ্ক মৌসুমে ধান উৎপাদনে (ইরি-বোরো) কৃষকেরা একসঙ্গে ১০ লাখের বেশি ডিজেলচালিত ও বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র ব্যবহার করেন। এর ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। ১৯৭০ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে ধান উৎপাদন তিন গুনের বেশি বেড়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, গবেষণা এলাকার ২৫ শতাংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। আর ৪০ শতাংশ এলাকায় শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে পানির স্তর স্থিতিশীল থাকে। বাকি ৩৫ শতাংশে শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপক সেচের কারণে স্তর নেমে যায়। তবে বর্ষাকালে অ্যাকুইফারগুলো আবার (পানি) ভর্তি হয়ে যায়।
কাজী মতিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এখানে প্রচুর নদ-নদী রয়েছে। ভৌম জলাধার যদি আগে থেকেই পূর্ণ থাকে তাহলে বর্ষাকালে পানি ভৌম জলাধারে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না। পানি ভৌম জলাধারে তখনই প্রবেশ করতে পারে যখন জলাধারে জায়গা থাকে। আর ভৌম জলাধারে জায়গা তখনই তৈরি হয় যখন কৃষক ভূগর্ভস্থের পানি ব্যবহার করেন।’
১৯৮৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এই অতিরিক্ত মিঠা পানি ভূগর্ভে জমার হওয়ার পরিমাণ ৭৫ থেকে ৯০ ঘন কিলোমিটার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের হুভার ড্যামে ৩০ বছরে ধারণ করা পানির দ্বিগুণের বেশি। আর বছরে যে পরিমাণ অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশের ভূগর্ভে প্রবেশ করে সেটির পরিমান যুক্তরাজ্যের মোট বাৎসরিক পানির ব্যবহারের চেয়ে বেশি। এ তথ্য জানান ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক মোহাম্মদ শামসুদ্দুহা।
গবেষক কাজী মতিন আহমেদ বলেন, ‘ফসলের ফলন বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত এই “বাংলা পানি যন্ত্র” (সেচযন্ত্র) বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমাতেও সহায়তা করে থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘ভূগর্ভে ভৌম জলাধারে যদি কোনো পানিই প্রবেশ না করতে পারে তাহলে সেটি তো ভূপৃষ্ঠে থেকে যাবে। এতে বড় আকারের বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে।’
অবশ্য সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বিশ্বের অনেক স্থানেই টেকসই সমাধান নয়। উত্তর ভারত, পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর চীন এবং অন্যান্য শুষ্ক স্থানে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভৌম জলাধার কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যেসব স্থানে ভূগর্ভে যথেষ্ট পরিমানে পানি নেই সেখানে গত দুই দশকে সেচের কারণে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ শুষ্ক ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ এবং একই রকম ভূপ্রকৃতি ও মৌসুমী বর্ষা প্রবণ এলাকা যেমন—পূর্ব ভারত, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ, ভূগর্ভস্থ পানির অধিক সেচ থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বন্যা সুরক্ষা—এই দ্বৈত সুবিধা পেয়ে থাকতে পারে। এমনটিই বলেছেন ভারতের আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের গবেষক অদিতি মুখার্জি।
অদিতি বলেন, ‘আমরা এর কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবটা এখনো ভালোভাবে জানি না। সেচ কৃষকদের জলবায়ুর পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে হয়তো সহায়তা করছে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী খরা বা আরও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের সমস্যাগুলো সেচযন্ত্রের কারণে যেই সুবিধাগুলো আপাত পাওয়া যাচ্ছে সেটির গতিপ্রকৃতি বদলে দিতে পারে।’
Address: Kaniz Plaza, Zindabazar, Sylhet
United Kingdom, London Mobile :+447438548379
dialsylhetnews@gmail.com
Design and developed by AshrafTech