প্রকাশিত: ৯:৫২ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৬, ২০২৩
মনজু বিজয় চৌধুরী: সিলেট বিভাগের যতগুলো বন আছে তার মধ্যে সমৃদ্ধ একটি বন হচ্ছে কমলগঞ্জের রাজকান্দি সংরক্ষিত বন। এই বনটি হামহাম জলপ্রপাতের জন্য পর্যটকদের কাছেও পরিচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই বনকে অনেক গবেষক বন্যপ্রাণীদের ‘হটস্পট’ বলে অভিহিত করেন।
সম্প্রতি এই বনাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে ড্রিলিং ও ভূগভর্স্থ বিস্ফোরণে সংরক্ষিত এই রাজকান্দি বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া এলাকার তিনটি টিলাভূমি আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছে।
গতকাল বুধবার (১৫ মার্চ) রাজকান্দি বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া এলাকার তিনটি টিলা আগুনে পুড়ে যায়। একটি ড্রিলিং স্পটে মাটির রেকর্ডিং জিওফোন (ক্যাবল) পুড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, গত তিন সপ্তাহ ধরে পরীক্ষামূলকভাবে ভূগভর্স্থ বিস্ফোরণের ঘটনাও হয়েছে, যা আগামী সপ্তাহে আরও বড় আকারে হবে।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য এ বনের ভেতরে ড্রিলিং-ভূগর্ভে বিস্ফোরণে জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণির অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের শর্তসাপেক্ষে অনুমতি নিয়ে ৩ ডি সাইসমিক জরিপ কার্যক্রম শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মন্ত্রণালয়ের শতার্দির মধ্যে রয়েছে তুলনামূলক গাছপালাবিহীন ফাঁকা স্থানে ড্রিলিং করা, বনের ভেতরে যানবাহন প্রবেশ না করা ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর কোন কার্যক্রম না করা, গাছপালা কাটা ও বনজ সম্পদের ক্ষতি না করা। কিন্তু তার কোনো শর্তই মানা হচ্ছে না।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার ৫০০ বর্গ কি.মি. এলাকা নিয়ে সার্ভে, ড্রিলিং ও রেকর্ডিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করে বিজিপি, চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। পেট্রোবাংলার তত্ত্বাবধানে ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের নির্দেশনায় এ্যাকরেজ ব্লক-১৩ ও ১৪ এর অবমুক্ত এলাকায় ৩-ডি সাইসমিক জরিপ প্রকল্প গত জানুয়ারি পর্যন্ত বস্তি, চা বাগান ও হাকালুকি হাওর এলাকায় কার্যক্রম সম্পন্ন করে। সে সময় বস্তির বেশ কিছু বসতঘরের দেয়ালে ফাটল ধরার অভিযোগ উঠে। সবশেষে রাজকান্দি বনাঞ্চলে শর্তসাপেক্ষে জরিপ কাজের অনুমতি পায় ওই প্রতিষ্ঠান। তবে গ্যাস অনুসন্ধানে সংরক্ষিত বনে জরিপ কাজ জীববৈচিত্র্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ বলেও সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। বনটিতে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
পরিবেশকর্মী রিপন দে বলেন, রাজকান্দি সংরক্ষিত এই বনে এমন অত্যাচার আমাদের আহত করেছে।পার্বত্য এলাকা ছাড়া এত সমৃদ্ধ বন বাংলাদেশে আর নাই। আমাদের দেয়ালে পিঠ আটকে গেছে। আন্দোলন করা ছাড়া আর বিকল্প নেই। যদিও আন্দোলন বা যৌক্তিক কোন কিছুই কেউ শোনার নাই এখন। যার যেভাবে স্বার্থ যা, ইচ্ছে তাই করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক মুনতাসির আকাশ জানান, রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে গত বছর ৬ মাস গবেষণা করেছি। সিলেট বিভাগে প্রথমবারের মত এশীয় কালো ভালুক, বন-ছাগল, সোনালী বিড়াল, এশীয় ছোট নখযুক্ত ভোঁদড় সহ প্রায় ৪০ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ছবি ও স্থায়ী পপুলেশনের অস্তিত্ব আমরা পেয়েছি। এছাড়া এ বনে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির আবাস। এতো সমৃদ্ধ বন আর এ নিয়ে এতো তথ্য এই সিলেট বিভাগে কমই আছে। যেখানে আমরা মনেপ্রাণে চাই রাজকান্দি বনকে জাতীয় উদ্যান বা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হোক, সেখানে ড্রিলিং আর ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণের মত কাজ অত্যন্ত বেদনার এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত।
রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর বনবিট কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, এই বনাঞ্চলে লাউয়াছড়ার চেয়েও বেশি বন্যপ্রাণী রয়েছে। বনাঞ্চলটি এখনো ঘন সন্নিবেশিত। বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় অনেক বন্যপ্রাণীও এখানে রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, আমাদের মাথায় আসে না মন্ত্রণালয় কিভাবে এর অনুমতি দেয়। আমরা পূর্বেও দেখেছি সংরক্ষিত বনে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশকে নষ্ট করে গ্যাস অনুসন্ধান করতে। বনের মধ্যে বিস্ফোরণের কারণে বন্যপ্রাণি ও পাখিরা অন্যত্র ছুটে যাবে। আমরা বারবার এ নিয়ে কথা বলেছি, আন্দোলন করেছি কিন্তু দ্বায়িত্বশীলদের কানে তালা।
রাজকান্দি বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বনে আগুন লেগেছিল তবে সেটি যথাসময়েই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তাছাড়া আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে কেন আগুন লেগেছিল।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ভাল্লুক, বনছাগল সহ বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর উল্লেখযোগ্য আবাসস্থল রাজকান্দি বনাঞ্চল। সেখানে ড্রিলিং ও শুটিং করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কোন কারণে যদি মাগুরছড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আরও মারাত্মক হবে।’
এ ব্যাপারে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বলেন, ‘আগুন আমাদের জন্য লাগেনি। আগুন লাগার ঘটনাটি সত্য এবং আমরা নিজেরাও এর কারণ অনুসন্ধান করেছি। আমরা জেনেছি যে, যেসব জায়গায় আগুন লেগেছে তা স্থানীয় বসতির কাছাকাছি।’
বনের মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ড্রিলিং কাজ চলছে। মন্ত্রণালয়ের সকল শর্তাবলী মেনেই কাজ চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান।
Address: Kaniz Plaza, Zindabazar, Sylhet
United Kingdom, London Mobile :+447438548379
dialsylhetnews@gmail.com
Design and developed by AshrafTech