বড়লেখায় অবশেষে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর মামলা নিলো পুলিশ, ধর্ষক গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: ১০:০১ অপরাহ্ণ, জুন ১০, ২০২৩

বড়লেখায় অবশেষে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর মামলা নিলো পুলিশ, ধর্ষক গ্রেপ্তার

ডায়াল সিলেট ডেস্ক : মৌলভীবাজারের বড়লেখায় অপহরণের পর এক কিশোরীকে (১৭) ধর্ষণের ঘটনায় অবশেষে থানায় মামলা হয়েছে। শনিবার (১০ জুন) সকালে ওই কিশোরী বাদি হয়ে দুজনের বিরুদ্ধে এই মামলা করেছেন।

মামলায় উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের জামাল উদ্দিনের ছেলে জামিল আহমদকে (২১) প্রধান আসামি এবং একই ইউনিয়নের তেরা মিয়ার ছেলে বোরহান উদ্দিনকে (৩৫) দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলার পর পরই পুলিশ শনিবার (১০ জুন) দুপুরে প্রধান আসামি জামিল আহমদকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে।

এর আগে ন্যায় বিচারের আশায় থানা পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন ভুক্তভোগী কিশোরী ও তার পরিবার। এনিয়ে গতকাল শুক্রবার (০৯ জুন) ‘বড়লেখায় ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে উল্টো ভিকটিমের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পুলিশের, তোলপাড়’ শিরেনামে সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে  সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। এরপরই ওই কিশোরীকে ডেকে শনিবার (১০ জুন) সকালে মামলা গ্রহণ করে বড়লেখা থানা পুলিশ। মামলার পরই অভিযান চালিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণের মূল হোতা জামিলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জানা গেছে, গত ৭ মে ওই কিশোরীকে অপহরণ করে একাধিকবার ধর্ষণ করেন প্রতিবেশী যুবক জামিল আহমদ। এরপর ওই কিশোরীর মায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ মে কিশোরীকে উদ্ধার এবং অপহরণকারী জামিলকে আটক করেন শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই তাজুল ইসলাম।

অভিযোগ উঠেছে, কিশোরীকে উদ্ধারের পর ১৪ মে রাতে ঘটনাটি নিষ্পত্তির নামে শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল হক ও এএসআই তাজুল ইসলাম রহস্যজনক কারণে ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইনী কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো বৈঠক করে কিশোরীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এসময় বিয়েতে আপত্তি দেওয়ায় কিশোরীর মাকে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ইউপি সদস্য মখসুদ আহমদ রানা ও নারী ইউপি সদস্য নাসিমা বেগম। পরে ওই কিশোরীকে পুলিশ ধর্ষকের বাড়িতে পাঠায়। সেখানে বিয়ের পরিবর্তে উল্টো নির্যাতনের শিকার হয়ে গত ১৫ মে ওই কিশোরী তার বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। এই সুযোগে ওই যুবক অন্যত্র বিয়ে করে ফেলেন। এ অবস্থায় কিশোরীর পরিবার পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে আদালতে মামলা করতে যান। সেখানে আইনজীবী সহকারি প্রভাবিত হয়ে ধর্ষণ ও অপহরণের মামলার পরিবর্তনে যৌতুকের মামলা লিখে দেন। লেখাপড়া না জানা কিশোরী না বুঝে এতে স্বাক্ষর করেন।

এদিকে গত ২৯ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার কিশোরী মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিশোরী মা জানিয়েছেন, বর্তমানে তার মেয়ে অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়েছে।এই ঘটনাটি জানাজানির পর এলাকায় তোলপাড় চলছে। স্থানীয়রা ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত যুবকের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা কিশোরীর সঙ্গে পুলিশের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ভুক্তভোগী কিশোরীর মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করেছে জামিল। ফাঁড়িতে অভিযোগ দিয়েছিলাম। তাজুল স্যার উদ্ধার করে মেয়েকে আমার কাছে না দিয়ে আইসি রবিউল স্যারকে নিয়ে  বৈঠক বসান। আমার আপত্তি সত্তে্বও তাজুল স্যার ও রবিউল স্যার আমার মেয়েকে জামিলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার সাথে পাঠিয়ে দেন। এরপর একটা সাদা কাগজে তাজুল স্যার আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনা আপোষ হয়েছে, এ জন্য স্বাক্ষর দিতে হবে’।

আমি স্বাক্ষর না দেওয়ায় আমাকে ফাঁড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি কোনোদিন ফাঁড়িতে আসবা না, আমার সামনেও পড়বা না’। তখন অভিযোগের কপিটা চাইলে ওঠা না দিয়ে তাড়িয়ে দেন। কয়েকদিন পর আমার মেয়েকে জামিল ও তার পরিবার বিয়ে না করিয়ে নির্যাতন করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমি থানায় ধর্ষণ মামলা করতে গেলে খবর পেয়ে তাজুল স্যার আমাকে আপোষ করে দেবেন বলে মামলা না করতে বলেন। এরপর তাজুল স্যার আমাকে ঘুরাতে থাকেন। এই ফাঁকে জামিল বিয়ে করে ফেলে। কোর্টে মামলা করতে গেলে মরির ভুল মামলা লিখে দিয়েছে। মরির লিখে দিয়ে স্বাক্ষর দিতে বলায় মেয়ে স্বাক্ষর দিয়েছে। আমার মেয়েকে মৌলভীবাজারে নিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছি। আমার মেয়ে গর্ভবতী বলে জানিয়েছে ডাক্তার। এখন আমার মেয়েটির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। কোথাও গিয়ে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না।’

তদন্ত কেন্দ্রে ওই বৈঠকের বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মখসুদ আহমদ রানা বলেন, ‘ঘটনাটি আমি জানতাম না। তদন্ত কেন্দ্র থেকে আমাকে ফোন দিয়ে নেওয়া হয়। এখানে (তদন্ত কেন্দ্রে) যা সিদ্ধান্ত হয়েছে পুলিশই নিয়েছে। আমরা কোনো কথা বলিনি। শুধু উপস্থিত ছিলাম।’

নারী ইউপি সদস্য নাসিমা বেগম বলেন, ‘পুলিশ উভয় পক্ষের সাথে কি কথা বলেছে ওঠা আমরা শুনিনি। তারা কথা বলেছে। আমি পাশের রুমে ছিলাম। আলোচনা শেষে শুধু জানানো হয়েছে মেয়ে-ছেলের বিয়ে হবে। বিয়ে যেদিন হওয়ার কথা ছিল সেদিন বিয়ে হয়নি। আমরা গিয়েছিলাম। শুনেছি আগের রাতে মেয়েকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাই মেয়েটি আমাদের উপস্থিতিতে কৌশলে পালিয়ে এসেছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কিশোরীর ঘটনাটি আইসি স্যার সমাধান করে দিয়েছেন। উনার বক্তব্য নেন।’শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল হক বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি কখনো বসি নাই। সমাধানও করি নাই। বিষয়টা এএসআই তাজুল ভালো বলতে পারবেন।’বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়ারদৌস হাসান বলেন, ‘কিশোরী শনিবার বড়লেখা থানায় অপহরণের পর ধর্ষণের অভিযোগে দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলার পরপরই অভিযান চালিয়ে মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলমান আছে।’

কিশোরীর পরিবার শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক ও এএসআইয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সিনিয়র অফিসাররা বিষয়টি অবগত হয়েছেন। ’

0Shares