আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে নিহত সাংবাদিক নাদিম, পরিকল্পনাকারী চেয়্যারম্যান বাবু পলাতক

প্রকাশিত: ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৭, ২০২৩

আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে নিহত সাংবাদিক নাদিম, পরিকল্পনাকারী চেয়্যারম্যান বাবু পলাতক

ডায়ালসিলেট ডেস্ক ::  আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে খুন হয়েছেন মানবজমিন পত্রিকার সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম। আগে থেকেই জীবননাশের হুমকি পেয়েছিলেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বুধবার পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফিরছিলেন মানবজমিনের বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি গোলাম রাব্বানী নাদিম। পথিমধ্যে বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি মোড়ে দেখা হয় দেশবাংলা পত্রিকার স্থানীয় সাংবাদিক আল মুজাহিদ বাবু ও অধিকারের সাংবাদিক এমদাদুল হক লালনের সঙ্গে।

সময় নাদিম তাদের জানান, চেয়ারম্যানের দায়ের করা মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। ওই মামলার ১নং অভিযুক্ত ছিলেন নাদিম। আল মুজাহিদ ছিলেন ৩নং অভিযুক্ত। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তারা ৩ জন কিছুক্ষণ কথা বলার একপর্যায়ে লালন চলে যান। পরে আল মুজাহিদ চলে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল স্টার্ট করেন। এ সময় আচমকা কোথা থেকে এসে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন তাঁতীলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম নাদিমের গলা ধরে ফেলে দেয়। নাদিম ‘মামা’ বলে ডাক দিলে আল মুজাহিদ পেছন ফিরে এ ঘটনা দেখে তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন।

এ সময় ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য মনির, সাইদুর রহমান সাঈদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক রাকিব বিল্লাহসহ ৫-৬ জন নাদিমকে মারতে মারতে টিএনটি রোডের নির্জন এলাকায় নিয়ে যেতে থাকে। আল মুজাহিদ পেছন পেছন যেতে চাইলে তাকেও মারধর করে। এ সময় চেয়ারম্যানপুত্র ফাহিম ফয়সাল রিফাত ইট হাতে নিয়ে আল মুজাহিদকে শাসায়। এতে ভীত হয়ে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন।

খুনের মূল পরিকল্পনাকারী হলেন সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। তার আগে একাধিকবার হামলা-মামলা ও হুমকি-ধমকি দিয়ে ক্ষোভ জানান দেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক। সর্বশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেন নাদিমসহ আরও ৩ জনের বিরুদ্ধে। মামলার ভিত্তি না থাকায় আদালত গত বুধবার তা খারিজ করে দেন। এর পর পরই নাদিমকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় চেয়ারম্যান গ্যাং। কালক্ষেপণ না করে ওই রাতেই কিলিং মিশনে নামে চেয়ারম্যান ও তার বাহিনী।

এছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় চেয়ারম্যান বাবুর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।

সিসিটিভি’র ফুটেজে তাকে দেখা না গেলেও তিনি অদূরেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দু’দফা নামাজে জানাজা শেষে গতকাল সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিক নাদিমকে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নামাজে জানাজায় অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামজিক সংগঠন, জেলার সাংবাদিক সমাজ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও বিপুলসংখ্যক মানুষ।

পরে বকশীগঞ্জ থানার সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন সাংবাদিকসহ স্থানীয় জনতা। এ সময় তারা বলেন, গোলাম রাব্বানী নাদিম নীতির সঙ্গে কখনো আপস করেননি। নানা হুমকি-ধামকি ও প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি সততার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সমাবেশ থেকে ইউপি চেয়ারম্যান বাবুসহ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।

আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, অন্ধকার নির্জনে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। নাদিমকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার পর তিনিও তাদের সঙ্গে মারপিটে যোগ দেন। তাদের ইটের আঘাতে এবং এলোপাতাড়ি মারধরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নাদিম। এদিকে, আল মুজাহিদ-এর ফোন পেয়ে লালন ও অন্যরা ছুটে আসলে অচেতন অবস্থায় ফেলে চলে যায় চেয়ারম্যান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। পরে মৃতপ্রায় নাদিমকে উদ্ধার করে প্রথমে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে জেলা সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন বিকালেই তিনি মারা যান।

উল্লেখ্য, একের পর নানা অপকর্ম করে গেছেন সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। ছলনা করে সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেন তিনি। যদিও স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে তার। পরবর্তী সময়ে সাবিনা ইয়াসমিনের সংসারেও এক কন্যা সন্তান হয়। গত ৮ই মে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তারিখ পিছিয়ে ওই নারীকে তালাক দেন তিনি। এ নিয়ে একাধিক রিপোর্ট করেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম।

এরই জের ধরে নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগেও বাবুর তার ইন্ধনে গত ১১ই এপ্রিল হামলা করা হয় নাদিমের ওপর। এ ছাড়া মাস দেড়েক আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় নাদিমকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন মাহমুদুল আলম বাবু। তাকে হত্যা করা হতে পারে এমন আশঙ্কার কথাও বলেছিলেন। এ নিয়ে গত ১৪ই মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উল্ঠো মামলাও করেন বাবু। মামলাটি বুধবার খারিজ করে দেন আদালত। আর ওই দিনই নাদিমের উপর হামলা হয়।

পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুরে মারা যান নাদিম। ইতিমধ্যে সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িত ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা হলেন-গোলাম কিবরিয়া সুমন, মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন, আইনাল হক, কফিল উদ্দিন, শহিদ ও ফজলু।

পরিবারের পক্ষ থেকে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুকে এই হামলা ও হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছে। নিহত নাদিমের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত জানান, বাবার দাফন শেষে পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মাহমুদুল আলম বাবু চেয়ারম্যান ও তার ছেলে ফাহিম রিফাতের নামে মামলা দায়ের করবো। ঘটনার পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু।

বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানা জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। বাবু চেয়ারম্যানকেও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ