মৌলভীবাজারের চার প্রতিবন্ধী মেয়ের জার্মানীর স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণালী সাফল্য

প্রকাশিত: ৭:০৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ৪, ২০২৩

মৌলভীবাজারের চার প্রতিবন্ধী মেয়ের জার্মানীর স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণালী সাফল্য

মনজু বিজয় চৌধুরী॥ চারজনের কারোই বাকশক্তি ও শ্রবণশক্তি নেই। তার উপর তারা সবাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধীও। অন্য সব স্বাভাবিক মানুষের মতো জ্ঞান বুদ্ধি তাদের নেই। জন্মগতভাবেই তারা প্রতিবন্ধকতার শিকার। বর্তমানে তারা অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হিসেবে পরিচিত। বাকশক্তি ও শ্রবণশক্তি না থাকলেও তাদের ¯œায়বিক শক্তি প্রচন্ড। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব শিশুরা গ্রাম্য সামাজিক ব্যবস্থায় অনেকটা অচ্যূত হলেও মৌলভীবাজারের মাহিমা আক্তার, তানিয়া আক্তার সুমাইয়া, রিয়া রানী দাশ ও মহিমা খাতুন মীম নামের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন চার শিশু জার্মানীর বার্লিনে অনুষ্ঠিত এবারের সামার স্পেশাল অলিম্পিকে তিনটি ইভেন্টে নিজেদের অসাধারণ নৈপন্য দেখিয়ে জয়লাভ করেছেন স্বর্ণপদক, স্পেশাল অলিম্পিকের আসরে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। তাদের অসাধারণ এ সাফল্যে পুরো জেলাজুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা।
জানা যায়, চলতি বছরের ১৭ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত জার্মানীর বার্লিনে অনুষ্ঠিত এবারের সামার স্পেশাল অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে ৭৯ জন খেলোয়ার ও ৩৪ জন কর্মকর্তা, কোচ, সহকারী কোচ, চিকিৎসক অংশ নেন। ওই ৭৯ জন খেলোয়ারের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলা থেকে চারজন মেয়ে এবারের স্পেশাল অলিম্পিকে অংশ নেয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী মহিলা ফুটবল দলের সদস্য দুইজন এবং বাকি দুইজন এ্যাটলেট। জেলার চার জন খেলোয়ারের সবাই নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে দেশের জন্য গলায় ঝুলিয়ে এনেছে স্বর্ণপদক। এবারের স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী মৌলভীবাজারের চার ক্রীড়াবিদই জেলার সদর উপজেলার ‘ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল’-এর ভোকেশনাল শাখার শিক্ষার্থী।
স্পেশাল অলিম্পিকের পঞ্চম দিনে ২২ জুন মেয়েদের এফ ও ওয়ান ফ্রিস্টাইলে মৌলভীবাজারের মাহিমা আক্তার এবং অন্যান্য তিন প্রতিযোগি মিলে বাংলাদেশকে এনে দেয় স্বর্ণপদক। এর পরদিন আসরের মর্যাদাপূর্ণ ১০০ মিটার দৌড়ে দেশের হয়ে স্বর্ণ জিতেন মৌলভীবাজারের তানিয়া আক্তার সুমাইয়া।
২৪ জুন অনুষ্ঠিত লেভেল থ্রি সেভেন এ সাইড ফুটবলের ফাইনালে বাংলাদেশ স্পেশাল নারী ফুটবল দল শক্তিশালী ইসরাইল স্পেশাল নারী ফুটবল দলকে ২-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়। দলের পক্ষে মৌলভীবাজারের রিয়া রানী দাশ গোলরক্ষক ও মহিমা খাতুন মীম রক্ষণভাগের প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। শক্তিশালী ইসরাইলের মুর্হুমুহু আক্রমন একের পর এর নস্যাৎ করে দেয় তারা। প্রথমার্ধ গোলশুন্য অবস্থায় শেষ হবার পর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ দল কাউন্টার এটাকে দুটি অসাধারণ গোল দিয়ে শিরোপা লাভ করে। পুরো প্রতিযোগিতায় রিয়া রানী দাশ ও মহিমা খাতুন মীম অসাধারণ নৈপুন্য প্রদর্শণ করে।
১০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণজয়ী তানিয়া আক্তার সুমাইয়া (১৫) মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের সালামিটিলা গ্রামের সজ্জাদ মিয়ার মেয়ে। ২ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সুমাইয়া। তার ছোটভাইও প্রতিবন্ধী।
সাঁতারে স্বর্ণজয়ী মাহিমা আক্তার (১৬) মৌলভীবাজার শহরের সৈয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাহান মিয়ার মেয়ে। ২ ভাই ১ বোনের মধ্যে সবার বড় মাহিমা। দীর্ঘদিন ধরে তারা সপরিবারে মৌলভীবাজারে বসবাস করে আসছে।
স্পেশাল নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের গোলরক্ষক রিয়া রানী দাশ (১৬) মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের আটগাঁও গ্রামের অজয় দাশের মেয়ে।
স্পেশাল নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের রক্ষণভাগের খেলোয়ার মহিমা খাতুন মীম (১৭) মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কনকপুর ইউনিয়নের নলদাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রউফের মেয়ে। ৪ বোনের মধ্যে মীম তৃতীয়। তার বড়বোনও প্রতিবন্ধী।
সন্তানদের প্রতিবন্ধীতায় ভবিষ্যত নিয়ে পরিবারগুলোর কপালে চিন্তার ভাজ থাকলেও তাদের এ অসাধারণ ক্রীড়া নৈপন্য এবং দেশের হয়ে জার্মানীর মাটিতে স্বর্ণজয়ের পর পুরো জেলাবাসীর সাথে ওই চার পরিবারেও বইছে আনন্দের বন্যা। স্পেশাল ফুটবল দলের রক্ষণভাগের অতন্ত্র প্রহরী মহিমা খাতুন মীমের বাবা আব্দুর রউফ বলেন, ‘আমার চার মেয়ের মধ্যে দুইজন প্রতিবন্ধী। তাদের নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিল না। কিন্তু আমার তৃতীয় মেয়ে মীম দেশের হয়ে স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতাতে ভূমিকা রাখায় আমার সকল কষ্ট সুখে পরিণত হয়েছে। এখন আমি গর্ব করেই বলতে পারছি স্পেশাল অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য আমার মেয়ে। আমরা সবাই তার সাফল্যে আনন্দিত।’
মৌলভীবাজার ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল’র প্রধান শিক্ষক মল্লিকা রানী গোস্বামী বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের চার শিশু মৌলভীবাজার জেলার মুখ উজ্জল করেছে। জার্মানীর বার্লিনে অনুষ্ঠিত স্পেশাল অলিম্পিকে চারজনই বাংলাদেশের হয়ে স্বর্ণপদক জয়ে আমরা আনন্দিত। সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিচর্চা পেলে প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমাজের বোঝা না হয়ে অহংকার হতে পারে তার প্রমাণ মাহিমা, সুমাইয়া, রিয়া ও মীম। তাদের নিয়ে আমরা গর্বিত।
ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল’র প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক ডি. ডি রায় বাবলু বলেন, ‘আমার জীবনের আর কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। যা চেয়েছিলাম তার থেকে অনেক বেশি দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। এ চার প্রতিবন্ধী শিশু এখন শুধু আমাদের নয়, পুরো জেলাবাসীর গর্বের ধন।’
মৌলভীবাজার জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মো. মাজহারুল মজিদ বলেন, ‘আমি আনন্দিত, আমি উৎফুল্ল। মৌলভীবাজারের ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল’র চার শিক্ষার্থী দেশের জন্য লড়াই করে দেশকে স্বর্ণপদক এনে দিয়েছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের জেলার চার প্রতিবন্ধী শিশু দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। আমরা সদর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের অভিনন্দিত করছি। তাদের সাফল্যে পুরো জেলাবাসী ভাসছে আনন্দের হিল্লোলে।

0Shares