ডায়াল সিলেট ডেস্ক: পড়ন্ত বিকেল। পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। শতাধিক টিনএজ ছেলেমেয়ের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে আছে চারপাশের পরিবেশ। মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে কেউ কেউ তুলছে দু’একটা (স্থিরচিত্র) সেলফি। কেউ কেউ করছে টিকটক। কেউ আবার প্রিয়জনের সাথে খোশগল্প করে কাটাচ্ছে কিছু আনন্দঘন সময়। বিকেলের মৃদু হাওয়া, দিন শেষে সূর্যাস্ত আর আড্ডার আসর, সব যেনো মিলেমিশে একাকার। এ যেনো আপন মহিমায় হাঁরিয়ে যাওয়ার মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ।
রাজধানী ঢাকার সাথে ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ জেলার দুরত্ব কমানোর জন্য জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নে কুশিয়ারার নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছিলো সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম রাণীগঞ্জ সেতু। উদ্ভোধনের পর থেকে এই সেতু হয়ে উঠেছে আশপাশ এলাকাবাসীর কাছে মিনি পর্যটন স্পট। বিকেল হলেই আশপাশ এলাকা এমনকি দুর-দুরান্ত থেকে শ’য়ে শ’য়ে ছেলে-মেয়ে জড়ো হচ্ছে সেতুতে। সাপ্তাহিক ছুটিতে জনসমাগম আরো বেড়ে যায়। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা লাঘবে বিকেল হলে একটু হাওয়া খাওয়া, নিজের মতো করে একটু হাঁটাচলা, সময় কাটানোর জন্য এই সেতুকেই বেছে নিয়েছেন আশপাশ এলাকার মানুষজন। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে দেখা কুশিয়ারা নদীর জলে অস্তগামী সূর্যের হাঁরিয়ে যাওয়া, কিংবা সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীরে একটু মুক্ত হাওয়ার পরশ দেহ-মন দু’টোই জুঁড়িয়ে যায়। তাইতো প্রতিদিন বিকেলে অসংখ্য মানুষ ভীড় করছেন সেখানে।
তথ্য প্রযুক্তির এ যুগেও প্রাকৃতি মানুষকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। যার প্রমাণ রাণীগঞ্জ সেতু। এ সেতু হয়ে উঠেছে তরুণদের বৈকালিক আড্ডারস্থল। এখানে গেলে সেতু শব্দের একাধিক ভিন্ন অর্থ মনে হয়ে যে কারো কাছে। মনে হবে, সেতু মানে শুধু গাড়ি পারাপারের সংযোগ বন্ধন নয়; সেতু মানে বেড়ানোর জায়গা, সেতু মানে অবসর সময় কাটানোর স্থান। সেতু মানে আনন্দ-উল্লাস উপভোগের জায়গা। দুর-দুরান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা ও বিনোদনপ্রেমীরা জড়ো হওয়ার কারণে সেতুর টুল প্লাজা সংলগ্ন জুড়ে পসরা সাঁজিয়ে দোকান খুলে বসেছে ভ্রাম্যমান ফুসকা, চটপটি, চা-ওয়ালা, বাদাম, চানাচুর ও ঝালমুড়ি ওয়ালারা।
শুক্রবার (১৪ জুলাই) বিকেলে সেতুতে ঘুরতে আসা নাজমা বেগম বলেন, আমরা যারা আাশপাশ এলাকার বসবাসকারী, আমাদের জন্য অবসর সময় কাটানোর ভালো একটি জায়গা এই ব্রীজ। প্রশস্ত ব্রীজ হওয়াতে বিকেলে হাটাচলা করা যায়। ব্রীজের উপর থেকে ভালো করে নদী দেখা যায়। প্রাকৃতিক বাতাসে দেহমন জুড়িয়ে যায়।
বৌ ও বাচ্চা নিয়ে জগন্নাথপুর থেকে বেড়াতে আসা সরকারি চাকুরীজীবী রহমত আলী বলেন, সুযোগ পেলেই পরিবার নিয়ে বিকেলে এখানে ওখানে বেড়াতে যাই। আজ এই সেতুতে ঘুরতে এসেছি। সেতুটি দেখতে সত্যিই অসাধারণ। নদীর পাড়ে বিশুদ্ধ বাতাস টানতেই পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি। নদী, প্রাকৃতিক বাতাস, এত মানুষজন, সব মিলিয়ে অন্য রকম এক পরিবেশ তৈরি হয়ছে এখানে।
কথা হয় কয়েকজন টিকটকারের সঙ্গে। তারা সবাই প্রায় অভিন্ন কণ্ঠে জানান, তারা এখন প্রায়ই সেতুতে এসে টিকটক করেন, একক ও যৌথ বিভিন্ন সেলফি তোলেন। সেতু উদ্বোধনের পর থেকে তারা নিয়মিত এখানে আসেন। এখানে না এলে তাদের আড্ডা যেন পূর্ণতা পায় না।
প্রতিদিন বিকেল হলে এমন অগণিত মানুষের ঢল নামে রাণীগঞ্জ সেতু জুড়ে। নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে প্রতিদিন এখানে ছুটে আসেন শত শত মানুষ। চলে বিকেল থেকে দিনের আলো নিভে রাতের আঁধারে নেমে আসা পর্যন্ত সেতুর উপর ও আশপাশে আড্ডা, হইহুল্লোড়। বিনোদন পিপাসু মানুষের কাছে ‘সেলফি সেতু’, আবার টিকটকটরদের কাছে ‘টিকটক সেতু’ নামে পরিচয় পেয়েছে এটি।
স্থানীয়রা বলেন, আমরা আশা করি আগত দর্শনার্থীরা শালীনতা বজায় রেখে আমাদের এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। এখানে কোনো অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে বিরত থাকবেন।
যেহেতু বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে নানান ধরনের মানুষজন আসেন, তাই সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার ব্যাপারে বিশেষ পরিকল্পনার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেতুর অবকাঠামোগত সরকারি উন্নয়ন যাতে বিনষ্ট করা না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। দুর-দুরান্ত থেকে বিনোদন পিপাসু মানুষের আনাগোনাতে ওৎপেতে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা সেতু এলাকায় যেকোনো সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটাতে পারে। পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসা বিনোদন পিপাসুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত সহ যেকোনো অপতৎপরতা রুখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবসময় স্বাভাবিক রাখতে সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা উচিত বলে মনে করেন সচেতন মহল।
উল্লেখ্য, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ও ঢাকঢোল পিটিয়ে সুনামগঞ্জের পাগলা-জগন্নাথপুর-রাণীগঞ্জ-সৈয়দপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদীর ওপর সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম ‘রাণীগঞ্জ সেতু’র উদ্বোধন করা হয় গত ৭ নভেম্বর ২০২২ইং তারিখে।
এ সেতুটি নির্মাণের ফলে সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকা যেতে আর সিলেট ঘুরে যেতে হয় না। সুনামগঞ্জ সদর থেকে শান্তিগঞ্জ উপজেলা হয়ে জগন্নাথপুরে এই সেতুর ওপর দিয়ে হবিগঞ্জের আউশকান্দি হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে সরাসরি ঢাকা যাওয়া যায়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য অনুসারে, প্রায় ১৫৫ কোটি টাকায় সেতুটি নির্মাণ করেছে এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড কোম্পানি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সওজের চুক্তি অনুযায়ী ৭০২ দশমিক ৩২ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ দশমিক ২৫ মিটার প্রস্থের এই সেতুটিতে ১৫টি স্প্যান ও ১২টি পিলার আছে। এ সেতুটির আগে সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম সেতু ছিল সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর ওপর নির্মিত ধলাই সেতু। ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাগলা-জগন্নাথপুর-সৈয়দপুরের সড়কে রাণীগঞ্জ সেতুসহ ৩৬ কিলোমিটার অংশ সুনামগঞ্জ জেলার সীমানায় এবং বাকি ১০ কিলোমিটার হবিগঞ্জ জেলার সীমানায় পড়েছে।
এ সেতুর সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে হলে সংযোগ সড়কে সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পরেছে। বড় আকারের ও ভারী যানবাহন চলাচলের সুবিধার জন্য শান্তিগঞ্জ থেকে জগন্নাথপুর অংশে ২টি বেইলি সেতু আছে। এগুলো সরিয়ে নতুন সেতু নির্মাণ করা আবশ্যক। এছাড়াও, রাণীগঞ্জ থেকে আউশকান্দি সাড়ে ৩ কিলোমিটার সরু সড়কও প্রশস্ত করা প্রয়োজন। আশা করি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত উদ্যোগ নেবে।