জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গাজাবাসী

প্রকাশিত: ৩:৪৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০২৩

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গাজাবাসী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :: পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই। ভেঙে পড়েছে চিকিৎসাব্যবস্থা। নিরাপত্তাও নেই। ট্যাংকসহ ব্যাপক অভিযানের ঘোষণা দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শহরের বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যেতে বলা হয়েছে। তার পর থেকেই মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে থাকা সেই মানুষগুলোর ওপরও হামলা হয়েছে, ঘটেছে প্রাণহানি। রেহাই পাচ্ছে না রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও। এই অবস্থায় গাজা সিটির বাসিন্দাদের একেবারেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়ার আগে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘শেষবিদায়’ জানিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন।

 

অনেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগ উঠেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী সাদা ফসফরাস ব্যবহার করছে, যদিও তা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করছে না ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররাও গাজার মানবিক বিপর্যয় নিয়ে কিছু বলছে না। সৌদি আরবও নীরব। যদিও ইরান, কাতার ও সিরিয়া এই মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে।

 

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা স্থগিত করেছে সৌদি আরব। সংশ্লিষ্ট সূত্র গতকাল শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্রটি বলেছে, আলোচনা স্থগিতের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করেছে সৌদি আরব।

 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি শান্ত করতে চীনের প্রতি তার প্রভাব ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গতকাল ঘণ্টাব্যাপী এক টেলিফোন আলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইকে এই অনুরোধ জানান।

 

ঘনিয়ে আসছে সময়, ছুটছে গাজা সিটিবাসী : গত শনিবার হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকেই গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে প্রাণহানি, আহতের সংখ্যা। বিদ্যুৎ না থাকায় চিকিৎসার সরঞ্জাম ফুরিয়ে আসায় উপত্যকার ১৩টি হাসপাতালের কোনোটিই ঠিকভাবে চলতে পারছে না। ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ চিকিৎসা নিতে আসায় হাসপাতালের করিডরে ঠাঁই দিতে হচ্ছে তাদের। এই অবস্থায় গাজাবাসীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার সরঞ্জাম প্রয়োজন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে এ ধরনের কোনো সহায়তা আসেনি।

 

জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নেয়ার ইস্ট (ইউএনআরডব্লিউএ) বলেছে, ২৩ লাখ বাসিন্দার গাজা উপত্যকায় কোনো প্রকার সহায়তা গতকাল শনিবার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এদিকে চিকিৎসার সরঞ্জাম ও জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যূত হয়েছে ৪ লাখের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত স্কুলগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে। তবে গাজায় জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও এখন আর নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব সংস্থাটি।

 

গাজার একটি ওষুধ প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ফার্মাকেয়ার গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাসিম খৌরি আল জাজিরাকে বলেন, ‘গাজায় গুটিকয়েক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আকারে ও সক্ষমতায় সেগুলো খুবই ছোট। তার ওপর এগুলোর কোনোটিই এখন উৎপাদনে নেই। ফলে এখানে চিকিৎসাব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। গাজার জন্য মানবিক সহায়তা না এলে বিপর্যয় ঘটে যাবে।’ তিনি জানান, গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফা হাসপাতালসহ সব হাসপাতালই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতিতে সমস্যায় পড়েছে। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

 

এদিকে ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, গাজায় পানির সরবরাহও ফুরিয়ে আসছে। এতে এই উপত্যকার ২৩ লাখ মানুষ ব্যাপক ঝুঁকিতে পড়েছে। ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে গাজাবাসী। সুপেয় পানি ফুরিয়ে আসছে। জ্বালানির সংকটে গাজার পানি শোধনাগার ও পানি সরবরাহব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। মানুষ এখন খোলা জায়গার পানি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে।’

 

শেষবিদায় জানিয়ে পোস্ট : তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলু জানায়, গাজা সিটিবাসী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ‘শেষবিদায়’ জানিয়ে সবার কাছে ‘ক্ষমা’ চেয়ে পোস্ট দিচ্ছেন। ইহাব আর সুলাইমান নামের এক ব্যবহারকারী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কারও কাছে কোনো অপরাধ করে থাকলে কিংবা ঋণ থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আপনাদের ক্ষমা করেছি, আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।’

 

এদিকে গাজা সিটির বাসিন্দাদের উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে সরতে বলা হলেও ইসরায়েল সেদিকেও বোমা ফেলছে। বিশেষ করে গাজার খান ইউনিস এলাকা এবং মিসরের সঙ্গে রাফাহ ক্রসিং এলাকায় বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এদিকে উত্তরাঞ্চলের লাখো মানুষ দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশে রওনা হওয়ায় ওই এলাকাটি লোকারণ্যে পরিণত হয়েছে।

 

বিবিসি জানায়, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকা একটি গাড়িবহরে শুক্রবার বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সালাহ-আল-দিন এলাকায় ওই হামলা হয়। এতে শিশুসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। শিশুদের বয়স ২ বছর থেকে ৫ বছরের মধ্যে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, ইসরায়েলি ওই হামলায় ৭০ জন নিহত হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, ঘটনাটি তদন্ত করছে তারা।

 

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত এক সপ্তাহে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ২১৫ জন হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায়ই নিহত হয়েছে অন্তত ৩২৪ জন। আহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে ৮ হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে। ইসরায়েলে প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি।

 

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ