রাজনগরে তিনশো বছর ধরে চলে আসছে রক্তবর্ণে দূর্গা প্রতিমার পূজা

প্রকাশিত: ২:৩৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০২৩

রাজনগরে তিনশো বছর ধরে চলে আসছে রক্তবর্ণে দূর্গা প্রতিমার পূজা
সালেহ আহমদ (স’লিপক): মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে রক্তবর্ণের দূর্গা প্রতিমার পূজা হয়ে আসছে তিনশো বছর ধরে। সনাতন ধর্মাবলম্বী পূজারীরা হাজারো দূর্গা প্রতিমা বিভিন্ন সাজে সাজিয়ে পূজা করে থাকেন। তবে এমন বর্ণে দূর্গা প্রতিমা আর কোথাও দেখা যায় না।
সোমবার (২৩ অক্টোবর) মহা নবমীর দিন দুপুরে পাঁচগাঁও গেলে দেখা যায়, হাজারো সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্ত পূজারীরা তাদের নানা মনস্কামনা নিয়ে ছুটে এসেছেন দুরদূরান্ত থেকে। পূজার নবমীতে ছয়টি মহিষ, হাজারখানেক পাঁঠা, অগণিত হাঁস ও কবুতর পশুবলি দেওয়া হয়েছে। আবার অনেকেই বস্ত্র, অলংঙ্কার নিবেদন করেছেন। কেউ হোমযজ্ঞ, কেউ প্রদীপ ও আগরবাতি প্রজ্জ্বলন করেন দেবীর উদ্দেশ্যে।
পূজাকে উপলক্ষ করে দূর্গা মন্দিরের আশপাশের অলিগলি ও রাস্তাঘাটে পসরা সাজিয়ে দোকান খোলে বসেন স্থানীয়রা। ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে প্রসাদ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বইছে খুশির আমেজ।
পূজায় আগত ভক্তদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, এখানে দেবী অন্য প্রতিমার চেয়ে ভিন্ন। তাই এখানে এসেছি। এখানে আসলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়।
পূজা পালনকারীরা জানিয়েছেন, দেশের আর কোথাও দেবী দূর্গার রং লাল বর্ণের নেই। শুধু ভারতের আসাম ও কামাক্ষ্যায় লাল বর্ণের প্রতিমা আছে।
বর্তমানে এই পূজা আয়োজনের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন সাধক সর্বানন্দ দাসের ষষ্ঠ বংশধর সঞ্জয় দাস। আলাপকালে তিনি জানান, ১৪১৫ বঙ্গাব্দে নতুন জায়গায় মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। তাই পূর্বের সেই স্মৃতিচিহ্ন এখন আর নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী মন্দিরে আগুন লাগিয়ে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে মন্দির পুড়ে গেলেও দেবীর গহনা এখনও অক্ষত আছে।
তিনি বলেন, এই পূজা আমাদের পারিবারিক পূজা। তবে দেবীর জাগ্রত উপস্থিতির কারণে প্রতিবছরই এখনে লোকসমাগম বাড়ছে। এজন্য পূজার এই ক’দিন হিমশিম খেতে হয়। তবে কোনো সমস্যা হয় না। এ ক্ষেত্রে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন।
উল্লেখ্য, মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের সাধক স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে তিনশো বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে লালবর্ণের দেবী দূর্গার পূজা। পাঁচগাঁও গ্রামের দূর্গাপূজা দেশের অন্য সবখানের চেয়ে আলাদা। কারণ, এখানকার দেবীর রং হয় লাল বর্ণের।
এলাকায় প্রচলিত আছে, স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সীপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। তিনি একবার আসামের কামরূপ- কামাক্ষ্যা বাড়িতে গিয়ে পূজার জন্য পাঁচ বছরের শিশু কন্যা চাইলে স্থানীয় লোকজন তাকে একজন শিশু কন্যা দেন। সাধক সেই কন্যা শিশুকে পূজা দেওয়ার এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে কন্যার গায়ের রং বদলে গিয়ে লাল হয়ে ওঠে। বিস্মিত সাধক বুঝতে পারেন, কন্যার মধ্যে স্বয়ং দেবী ভর করেছেন।
সেই কন্যা তখন সাধককে বলেন, তুমি আমার কাছে বর চাও। সাধক তখন তার কাছে বর চাইলেন। দেবী তখন নির্দেশ দিলেন পাঁচগাঁওয়ের প্রতিমার রঙ লাল হবে। সাধক দেবীকে রাজনগরের পাঁচগাঁওয়ে যেনো দেখা দেন সেই আকুতি জানান। সেই থেকে এখানে লাল বর্ণের মূর্তিপূজা হয়ে আসছে।
পূজার একপর্যায়ে সাধক দেবীর কাছে আকুতি জানান, তিনি (দেবীদূর্গা) যে এখানে এসেছেন তার প্রমাণ কী? তখন দেবীদূর্গা তার হাতের পাঁচ আঙুলের লাল ছাঁপ তৎকালীন নির্মিত কাঁচাঘরের বেড়ায় লেপ্টে দেন। দেবীর মাথার স্বর্ণের কলি রেখে যান। সেই থেকেই এখানে লাল বর্ণের মূর্তিতে দেবীর পূজা হয়ে আসছে। এমনকি পূজার সময় এখনো রেখে যাওয়া গয়না দেবীদূর্গার প্রতিমাকে পরানো হয়।
বৃহত্তর সিলেট ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি ভারত থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন এই পূজামণ্ডপে। পূজার সপ্তমী থেকে নবমী এই তিন দিন কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুঁড়ে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। প্রতি বছর উৎসবমুখর পরিবেশে দেশ বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীরা আসেন এ মণ্ডপে।
0Shares