চাহিদা বাড়ছে ঐতিহ্যের ‘ধুছনি’ দইয়ের

প্রকাশিত: ১১:৫২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১১, ২০২৩

চাহিদা বাড়ছে ঐতিহ্যের ‘ধুছনি’ দইয়ের

ডায়াল সিলেট ডেস্ক ::বিগত ২/৩ যুগ ধরে গৌরাঙ্গ দাসের (৫৪) পরিবার মাটির হাঁড়ির পাশাপাশি বাঁশের বেতের ঝুড়িতে (ধুছনি) দই পাতেন। পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে ধুছনির দইয়ের গুণগত মানও বজায় রেখেছেন তারা। স্থানীয়ভাবে বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাঁড়ির দইয়ের পাশাপাশি এগুলো কিনেন অনেকে। ভিন্ন স্বাদের এ ধুছনির দইয়ের আঁতুড়ঘর মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বর্নি ইউনিয়নের মিহারী গ্রামে। এটি তৈরি করা হয় গরু ও মহিষের দুধে। গোলগাল পাত্রটিও ভিন্ন ধাঁচের, বাঁশের বেতের তৈরি ঝুড়ি, যা ‘ধুছনি’ নামে পরিচিত।

সরেজমিনে বড়লেখা উপজেলার বর্নি ইউনিয়নের মিহারী গ্রামের গৌরাঙ্গ দাসের বাড়িতে দেখা গেছে, বাঁশ-বেতের তৈরি ছোট ঝুড়ি, যা ধুছনি নামে পরিচিত। সেই ধুছনির গায়ে ক্ষীরের মতো ময়দার প্রলেপ মাখিয়ে ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছেন এক নারী। তারপর সেই ধুছনিতে মহিষের দুধ ঢেলে দই পাতা হচ্ছে।গৌরাঙ্গ দাস বলেন, ‘আগে বাপ-দাদা বানাইছইন (তৈরি করেছেন)। এটা একবারে অরিজিনাল দুধের দই। অন্য কিছুই মিশাই না। হাওর এলাকায় ভইষের (মহিষের) দুধ মিলে। আমরা নিজের হাতে বানাই। কাইত (কাত) করলেও পড়ে না। গরুর দুধ দিয়াও করি। যার চাহিদা যেটা, ওটা নেয়।’

গৌরাঙ্গ দাস বলেন, এটা তাদের পারিবারিক ব্যবসা। তাদের গ্রামটি হাকালুকি হাওরের পাড়ে। হাওরে ঘাস, শালুকসহ নানা জলজ উদ্ভিদের প্রাচুর্য থাকায় অনেকেই গরু-মহিষ পালন করেন। এখনো হাওর পাড়ের এলাকাটিতে গরু-মহিষের নির্ভেজাল দুধ পাওয়া যায়। তারাও বাবা-দাদার পেশাটি ধরে আছেন। পাত্রের পরিচয় ও স্বাদের ভিন্নতায় এই দইয়ের আলাদা কদর রয়েছে। পাত্রটি বানানো হয় বাঁশ-বেত দিয়ে। এরও আলাদা কারিগর আছেন, তারা চাহিদামতো বানিয়ে দেন। যে বাঁশ-বেতের তৈরি পাত্রটিতে এই দই বসানো হয়, এটির স্থানীয় নাম ‘ধুছনি’। ধুছনিতে পাতা হয় বলে এর পরিচিতিও হয়েছে ‘ধুছনির দই’ নামে।

তবে শুধু পাত্রের নামেই এর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়নি। খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি হয় বলে স্বাদেও ভিন্নতা আছে। কারও চাহিদা না থাকলে এর মধ্যে চিনি বা অন্যকিছু মেশানো হয় না। দুই কেজি ও পাঁচ কেজি ওজনের ধুছনিতে দই বসানো হয়। প্রতি কেজি দইয়ের দাম ৩০০ টাকা। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু দইয়ের চাহিদা (অর্ডার) থাকে। কারও ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হয়, আবার কেউ এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যান। প্রতিদিন স্থানীয়ভাবে গরু-মহিষের মালিকের কাছ থেকে তারা দুধ সংগ্রহ করেন। দইয়ের চাহিদা না থাকলে সেই দুধ থেকে ছানা তৈরি করে নির্দিষ্ট মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করেন।

বিয়ে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এক মণ বা তারও বেশি চাহিদা থাকে। তখন বাইরে থেকে দুধ সংগ্রহ করতে হয়। হাকালুকি হাওর পারে ‘আবাদি’ বলে একটি বাজারে সকালবেলা দুধের হাট বসে। স্থানীয় গরু-মহিষের মালিক সেই হাটে টাটকা দুধ নিয়ে আসেন সেই হাট থেকে তাঁরা দুধ কিনেন। বড়লেখা ছাড়াও মৌলভীবাজারের জুড়ী, সিলেট ও সিলেটের গোলাপগঞ্জে এই দইয়ের চাহিদা রয়েছে। সেসব এলাকা থেকে ক্রেতারা দই নিতে আসেন।

এই ধুছনি তৈরি করেন বর্নির মিহারী-নওয়াগ্রামের বাসন্তি রানী দাস। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার বিধবা পুত্রবধূ (সবিতা রানী দাস) ধুছনি বানাই। বাপের (বাবার) বাড়ি স্কুলে (প্রাথমিক বিদ্যালয়) পড়ার সময় বেত-বাঁশের কিছু কাজ শিখেছিলাম। এখন এটা দিয়াই সংসার চালাই।’ তিনি বলেন, এলাকায় বাঁশ-বেতের কাজ দু-একটি পরিবার করে থাকে, তবে ওজন-মাপ ঠিক রেখে এই ধুছনি তারাই বানান। একটি ধুছনির দাম পড়ে ৪০ টাকা। এ ছাড়া ফুলের সাজি, ডালাসহ বাঁশ-বেতের অন্যান্য জিনিসও তৈরি করেন। এই বাঁশ-বেতের কাজ দিয়েই তাদের ১১ সদস্যের পরিবার চলে।

বর্নি ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, অনেক দিন ধরে তারা এই দই খান। মহিষের দুধ ঘন হয়, তাই এই দুধের স্বাদ আলাদা। এই দই শতভাগ প্রাকৃতিক। স্থানীয়ভাবে ধুছনির দইয়েরই চাহিদা বেশি। বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, সুস্বাদু এই খাদ্য পণ্যটি যাতে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় আমরা সে উদ্যোগ নিচ্ছি। এতে করে এর সাথে যুক্ত সকলেই উপকৃত হবেন।

0Shares