জুড়ী মুক্ত দিবস আজ

প্রকাশিত: ১২:৪০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৫, ২০২৩

জুড়ী মুক্ত দিবস আজ

ডায়াল সিলেট ডেস্ক : ৫ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের জুড়ীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে জুড়ী এলাকা (বর্তমান জুড়ী উপজেলা) মুক্ত হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকায় পুলিশ লাইনসহ ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সহযোগিতায় স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর চালায় অত্যাচারের স্টিমরোলার। তারই ধারাবাহিকতায় ১০ মে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জুড়ীতে প্রবেশ করে। শহরের ভবানীগঞ্জ বাজারে চিকন মিয়ার মালিকানাধীন দ্বিতল ভবন দখল করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। যেটা নির্যাতনশালা/হত্যাশালা বা টর্চার সেল নামে পরিচিতি পায়। ক্যাম্প ইনচার্জ ক্যাপ্টেন দাউদ খানের নেতৃত্বে সৈন্যরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য রাজাকার, আলবদরদের সহযোগিতায় জুড়ীতে শুরু হয় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। স্বাধীনতাকামী মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার পরিবারসহ সাধারণ নিরীহ মানুষদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করতো। হাত-পা বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করতো। এ ভবনের পিছনে জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকট জাগোধারী পুকুরে লাশ ফেলে দিতো। জুড়ী-ফুলতলা সড়কের বীরগুগালি হাওরে লাশ নিয়ে ফেলে দিতো হায়েনার দল।

মুক্তিযুদ্ধের সিইনসি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর তত্ত্বাবধানে ও ৪ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার সি. আর দত্তের নেতৃত্বে মোজাহিদ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন তৈমুছ আলী হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা শুরু করেন। মোজাহিদ সদস্যসহ অন্যান্য মুক্তিকামী যুবকদের সংগ্রহ ও সংগঠিত করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে পাঠান। পরে বিভিন্ন সাব-সেক্টরে ভাগ হয়ে দেশে প্রবেশ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দামাল ছেলের দল। গেরিলা যুদ্ধ ও সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যুদ্ধের মাঠ থেকে শেখ আব্দুন নূরকে আহতাবস্থায় ধরে নেয় ক্যাম্পে। আজো তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। সিলেটের হেতিমগঞ্জে সম্মুখ যুদ্ধে আহত হন আব্দুর রহিম। চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয় এবং লাশ সমাহিত করা হয়। বড়লেখার শাহবাজপুরে সম্মুখ যুদ্ধে সামনের সারিতে যুদ্ধ করছিলেন ফয়জুর রহমান। তখন পিছন থেকে অজান্তে সহকর্মীর গুলিতে তিনি শহীদ হন। একই এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চলাচল পথে স্থল মাইন পুঁততে গিয়ে একটি মাইন বিস্ফোরণে দুই হাত ও দুই চোখ হারান আব্দুস সহিদ চৌধুরী খুশী।

’৭১ সালের ১ ও ২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় ভারতের বাগপাশা থেকে অগ্রসর হয়ে রাঘনা নামক স্থানে ভারত-বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণকারী জুড়ী নদীর উপর অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী সীমান্তবর্তী ফুলতলা ইউনিয়নের ফুলতলা বাজার বিনা বাধায় দখল করে নেয়। রাতের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী সাগরনাল ইউনিয়নের ডিফেন্সও মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন সুখ লালসহ কিছু সংখ্যক সৈন্য রয়ে যান, বাকিরা জুড়ীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। রত্না চা বাগানের কাছে এসে পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হলে উভয়পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা গুলি বিনিময় হয়। এতে পাকিস্তানী বাহিনী পিছু হটে কাপনাপাহাড় চা বাগানের নিকট চলে যায়। যৌথবাহিনীও এখানে ডিফেন্স নেয়। পরদিন দিনভর পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধ চলে। এতে উভয়পক্ষের বেশ কিছু সৈন্য হতাহতের পর ঐ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী জুড়ীর দিকে পালিয়ে যায়। কাপনাপাহাড় থেকে যৌথবাহিনীর সৈন্যরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একদল কুলাউড়া শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে গাজীপুর চা বাগানের রাস্তা ধরে কুলাউড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অপর দল জুড়ীর দিকে এগিয়ে যায়। পরদিন ৪ ডিসেম্বর ভারতের কুম্ভিগ্রাম বিমানবন্দর থেকে কয়েকটি যুদ্ধ বিমান যৌথবাহিনীর সমর্থনে এসে জুড়ী ও কুলাউড়াতে সেলিং করতে থাকে। বিমান বাহিনীর সেলিংয়ের মুখে জুড়ীতে অবস্থানরত পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী টিকতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়ে গভীর রাতে পালিয়ে যায়। শত্রুমুক্ত হয় জুড়ী। মুক্তিযোদ্ধারা লাল-সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে শহরে প্রবেশ করে জয়বাংলা শ্লোগানে মুখরিত করে তোলেন গোটা অঞ্চল।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ