ডায়ালসিলেট ডেস্ক::জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্যের সঙ্গে লঞ্চের যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধির অনুপাত মিলছে না। ডিজেলের দাম যেখানে প্রতি লিটারে বেড়েছে ৩৫ টাকা, সেখানে কিলোমিটারপ্রতি প্রায় ৬৯ পয়সা বেশি গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। ফলে জ্বালানি ব্যয়ের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ টাকা আয় হচ্ছে মালিকদের। বিষয়টিকে সরকারি সিদ্ধান্তে ত্রুটি হিসাবে দেখছেন যাত্রীরা। তাদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে ভাড়া বাড়ানোর হিসাবে সমন্বয় না থাকায় এমনটা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মালিকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এদিকে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চে ডেক শ্রেণিতে ভাড়া বাড়লেও প্রথম শ্রেণির কেবিনে বাড়েনি। আপাতত কেবিনের ভাড়া বাড়ছে না-এমনটাই জানিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের নভেম্বরে শতকরা ৩৫ ভাগ বাড়ানো হয়েছিল লঞ্চের ভাড়া। তখন অবশ্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বা অন্য কোনো ইস্যু ছিল না। বৃদ্ধির ফলে সেসময় ঢাকা-বরিশাল রুটের ডেক শ্রেণির ভাড়া ২৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫২ টাকায়। চলতি মাসে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৫ টাকা বৃদ্ধি করে সরকার। সঙ্গে সঙ্গে আবার লঞ্চ ভাড়া বৃদ্ধির দাবি ওঠে। ভাড়া ৫০ ভাগ বৃদ্ধির দাবি জানান মালিকরা। সর্বশেষ সোমবার ঢাকায় নৌ-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে লঞ্চ মালিকদের বৈঠকে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকেই বরিশালের অভ্যন্তরীণ এবং দূরপাল্লার নৌরুটগুলোয় শুরু হয় বর্ধিত হারে ভাড়া আদায়। বরিশাল-ভোলাসহ অভ্যন্তরীণ প্রায় সব রুটে যাত্রীপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেশি ভাড়া আদায় শুরু করেন মালিকরা। দূরপাল্লার ঢাকা-বরিশাল রুটেও কার্যকর হয় নতুন ভাড়া। অবশ্য এখন কেবল ডেক শ্রেণিতে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। নতুন রেটে ডেকের ভাড়া দাঁড়িয়েছে ৪৫৭ টাকা। ডেকে বাড়লেও বাড়ানো হয়নি প্রথম শ্রেণির কেবিনের ভাড়া। আগের মতো সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া রয়েছে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকার মধ্যে। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এমনিতেই লঞ্চের যাত্রী কমেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কেবিনে। তাই আপাতত কেবিনে ভাড়া বাড়াচ্ছি না আমরা।’ এভাবে ভাড়া বৃদ্ধিতে ক্ষোভ আর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে যাত্রীদের মধ্যে। তার জানান, এই পক্রিয়ায় মালিকরা ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি টাকা পকেটে ভরবেন। বরিশাল-ভোলা রুটের নিয়মিত যাত্রী মোকাম্মেল হক বলেন, ‘অনেক বছর ধরে এই রুটে যাতায়াতের কারণে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই জানি। বরিশাল থেকে ভোলার ভেদুরিয়া ঘাট পর্যন্ত যেতে-আসতে একটি লঞ্চের কমবেশি ৮০ লিটার ডিজেল লাগে। সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি বাড়িয়েছে ৩৫ টাকা। এই হিসাবে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে এই রুটে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৮শ টাকা। আগে এই রুটে লঞ্চে ভাড়া দিতাম ৯০ টাকা। এখন ৩০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে যাত্রীপ্রতি। যেসব লঞ্চ এই রুটে চলাচল করে, তাদের যাত্রী ধারণক্ষমতা কমবেশি দেড় থেকে ২শ। প্রতি রাউন্ড ট্রিপে যদি সবমিলিয়ে ২শ যাত্রীও ভ্রমণ করে তাহলে ৩০ টাকা হিসেবে মালিকদের ৬ হাজার টাকা বাড়তি আয় হয়। অথচ ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৮শ টাকা। এর মানে হচ্ছে-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতি পুষিয়েও প্রতি রাউন্ড ট্রিপে বাড়তি আয় হবে ৩ হাজার ২শ টাকা।’ বরিশাল-হিজলা রুটের লঞ্চ যাত্রী দেওয়ান আরাফাত বলেন, ‘সরকার গড় হিসাব করে লঞ্চের ভাড়া বাড়ায়। নভেম্বর থেকে আগস্ট পর্যন্ত হিসাব করলে দুই দফায় ভাড়া বাড়লা ৬৫ ভাগ। সরকারের উচিত মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যাত্রী ভাড়া নির্ধারণ করা। আজ গড়ে ৩০ ভাগ ভাড়া বাড়িয়ে খরচের পরও বাড়তি লাভের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো মালিকদের। মাঝে থেকে আমরা জনগণ হলাম বলির পাঁঠা।’ বিষয়টি সম্পর্কে আলাপকালে বরিশাল লঞ্চ মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আজিজুল হক আক্কাস বলেন, ‘সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে তাতে বরিশাল-ভেদুরিয়া রুটে লঞ্চের ভাড়া দাঁড়ায় জনপ্রতি ১৩৮ টাকা। আমরা নিচ্ছি ১২০ টাকা। এরপরও কি আমাদের ওপর দায় চাপাবেন?’ বরিশালের নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে মাথাপিছু ১৮ টাকা কম নিয়েও মালিকরা লাভ করছেন। এই একটি তথ্যেই পরিষ্কার যে ভাড়া নির্ধারণের সরকারি পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ? সরকারি রেটে ভাড়া নিলে তো লাভের অঙ্ক আর ৩ গুণ বাড়ত। বিষয়টি সবার আগে সরকারকেই ভাবতে হবে।’ অভ্যন্তরীণ রুটের মতো ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকা-বরিশাল রুটেও। বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্যসচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘যতদূর জানি, প্রতি রাউন্ড ট্রিপে ঢাকা-বরিশাল রুটের একটি ডাবল ডেকার লঞ্চের ডিজেল ব্যয় হয় গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার লিটার। আমরা যদি গড়ে সাড়ে ৭ হাজার লিটারও ধরি, তাহলে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যয় বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৫শ টাকা। আগে যেখানে একটি লঞ্চের রাউন্ড ট্রিপে সবমিলিয়ে খরচ হতো ৬ লাখ ২০ হাজার, সেখানে এখন তা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকায়। এবার আসি বর্ধিত হারে ভাড়া আদায় প্রশ্নে। রাউন্ড ট্রিপে একটি লঞ্চ যদি ১৫শ যাত্রীও বহন করে তাহলে কেবল ডেকেই আয় দাঁড়ায় যাত্রীপ্রতি ৪৫০ টাকা হিসাবে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। লঞ্চ মালিকরা বলছেন প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ কেবিনের ভাড়া বাড়াচ্ছেন না তারা। ঢাকা-বরিশাল রুটের প্রায় সব লঞ্চেই গড়ে সোয়া দুই থেকে আড়াইশ প্রথম শ্রেণির আসন রয়েছে। রাউন্ড ট্রিপে যদি সাড়ে ৩শ আসনেও যাত্রী হয় তবে আগের ভাড়া ১২শ হিসেবে আয় দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ডেক এবং কেবিন মিলিয়ে ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয়ের বিপরীতে আয় দাঁড়াল প্রায় ১১ লাখ টাকা। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে একেকটি লঞ্চের ধারণক্ষমতা কিন্তু কম করে হলেও ৩ হাজার। রাউন্ড ট্রিপে ৬ হাজার যাত্রী ধারণক্ষমতার বিপরীতে আমরা ধরেছি মাত্র ১৫শ। কেবিনের ক্ষেত্রেও কিন্তু সাড়ে ৪ থেকে ৫শ আসনের বিপরীতে আয় হিসাব করা হয়েছে ৩৫০ আসনের। এর পাশাপাশি ধরা হয়নি ভিআইপি কেবিন এবং সোফার যাত্রীদের হিসাব। এত কিছু বাদ দেওয়ার পরও লঞ্চপ্রতি লাভের অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ টাকা। সরকার একটু হিসাব করলেই কিন্তু লঞ্চ মালিকদের এই বিপুল অঙ্কের লাভ থেকে খানিকটা কমিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরেকটু লাঘব করতে পারত।’ বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘কাগজে-কলমে লাখ টাকা লাভের হিসাব দেখালেই তা সত্যি হয়ে যায় না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রীসংকটে চরম লোকসান দিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছি আমরা। বলতে গেলে পুরো শিল্পটাই এখন ঝুঁকির মুখে। ভাড়া শতকরা ৫০ ভাগ বাড়ালে হয়তো টিকে যেতাম। ৩০ ভাগ বাড়ানোয় লঞ্চ চালিয়ে খরচ ওঠানো এখনো দুঃস্বপ্ন আমাদের কাছে। তাছাড়া কেবল জ্বালানি তেলই তো নয়, লঞ্চের যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য সামগ্রীর দামও তো বেড়েছে। সব মিলিয়ে সত্যিই বিপদে আছি আমরা।’
ডায়ালসিলেট এম/

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!
0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *