ডায়ালসিলেট ডেস্ক :: জিসান ও রাবেয়া স্বামী-স্ত্রী । ১৪ মাস আগে ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছেন। আঠারো বছর বয়সী আব্দুর রহমান জিসান দোকানে দোকানে পানি সরবরাহের কাজ করতেন। তার বাবা একজন প্রবাসী। মা, স্ত্রী ও একমাত্র বোনকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগ এলাকায়।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!
গত ২০শে জুলাই চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে আসেন বাবা বাবুল সরদার।
এলাকাজুড়ে বয়ে এসেছে শোকের মাতন। তবে এ পরিবারটিতে একজনের মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই নেমে আসে আরেকটি শোক। জিসানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী মিষ্টি। শোক সইতে না পেরে স্বামীর মৃত্যুর ৯ দিনের মাথায় আত্মহত্যা করেন রাবেয়া। একসঙ্গে ২ জনকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ ২টি পরিবার।
জিসানের মা জেসমিন বেগম বলেন, গত ২০শে জুলাই বিকালে রায়েরবাগ ২ নম্বর গলিতে শ্বশুরবাড়ির সামনেই গুলিবিদ্ধ হন জিসান। আমার দুই ছেলেমেয়ে। জিসান পরিবারের ছোট। ওরা আমার বাচ্চাটাকে গুলি করে মেরে ফেলছে। সে পানি সরবরাহের কাজ করতো। গুলিবিদ্ধ হওয়ার কতোক্ষণ আগেও ৭টা পানি দিয়েছে। চারিদিকে যখন এই গোলাগুলির শব্দ তখন অনেকে আতঙ্কে বের হয়ে দেখতে যায়।
এমনই আমার ছেলেও গলির মধ্যে বের হয়। ও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল জায়গাটা তার শ্বশুরবাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায়। গুলিটা এক চোখ হয়ে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়। গুলি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা বাবা বলে পড়ে যায় জিসান। পরে তাকে স্থানীয়রা একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিলে কিছুক্ষণ পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আামি খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে গেলে জিসানকে মৃত দেখতে পাই। পরেরদিন মেডিকেলের মর্গ থেকে তার মরদেহ দেয় আমাদেরকে। লাশ আনতেও অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।
জিসানের বাবা বাবুল সরদার বলেন, এমন ঘটনা ঘটবে আমি কখনো ভাবিনি। পাঁচ মাস হলো বিদেশ গিয়েছি। আট বছর ধরে বিদেশ থাকি। আমি একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমার দেশ আমার সন্তানের লাশ উপহার দিলো। ঘটনার দিন সকাল থেকে আমার কেমন যেন অস্থির লাগছিল।
পরে বাড়িতে অনলাইন-অফলাইন কল দিয়ে কোনোভাবে সংযোগ করতে পারছিলাম না। আমরা দুই জনের আয়ে আমাদের সুন্দর একটা সংসার ছিল। আমার ছেলেকে তার শখের মোটরসাইকেল কিনে দেইনি এক্সিডেন্টের ভয়ে। আর সেই ছেলেকে আজ গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলো। আমি আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।
রায়েরবাগে জিসানের বাড়িতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা বলেন, আমরা কারও কাছে বিচার চাই না, আমরা বিচার চাই আল্লাহর কাছে। জিসানের বাবা বিদেশে ছিল। ছেলের মুখটা শেষবারের মতো দেখার জন্য একরাত একদিন ছেলের মরদেহ ফ্রিজিং গাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম। সে সোমবার সন্ধ্যার আগে দেশে এসে পৌঁছায়। নেট না থাকায় তাকে খবর পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না। পরে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মোবাইলে রিচার্জ করে তাকে খবর জানানো হয়। জিসানের কোনো সন্তান নেই।
তিনি বলেন, ওদের দু’জনের মধ্যে অনেক ভালোবাসা ছিল। তাদের সম্পর্ক করে বিয়ে হয়। বউ তার স্বামীর মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। জিসান মারা যাওয়ার পর তার ব্যবহৃত পোশাক নিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখতো। কোনো খাবার খাওয়াতে পারিনি। স্বামীর শোকে ২৯ তারিখ দুপুরের দিকে ওর বাবার বাড়িতে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দেয়। আমার ছেলের বউ তার বাবার বাড়িতে যাওয়ার সময় আমাকে বলে, আম্মু তুমি অসুস্থ মেডিকেলে যাও। আমি তাকে বুঝিয়েছি অনেক।
সে যতদিন বাঁচবে মেয়ের মতো আগলে রাখবো। আশপাশে কোনো মানুষের কোনো কথায় কান দিবা না। পাগলামি করতো, দরজা আটকায় দিতো। আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকেই বউ মারা যাওয়ার কথা বলতো সবসময়। আর বলতো তার স্বামীর পাশে তাকে যেন দাফন করা হয়। ছেলেকে মাতুয়াইল কবরস্থানে দাফন করা হয় আর বউকে তার বাবার বাড়ি রংপুরে দাফন করা হয়।

