ডায়ালসিলেট ডেস্ক :: ইভ্যালির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য তিনটি পথ খোলা আছে। এর একটি হচ্ছে, ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের, দ্বিতীয়টি, দাবি আদায়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ দিতে হবে। তৃতীয়, প্রতারণার জন্য বাংলাদেশ প্রতিযোগী কমিশনে অভিযোগ দিতে হবে গ্রাহকদের। একই সঙ্গে তিনটি পথই তাদের অনুসরণ করতে হবে। ই-কমার্স সংক্রান্ত আলাদা কোনো আইন নেই। কাজেই বিদ্যমান আইনে তাদের সাজা এবং এই তিন কৌশলে টাকা ফেরত পাওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

এদিকে রোববার সচিবালয়ে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ই-কমার্সে যারা প্রতারণা করবেন, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ইভ্যালির মতো আরও কয়েকটা প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের সম্পর্কেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডির বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, গ্রাহকদের টাকা ফেরত চেয়ে আদালতে আবেদন করতে হবে। বিষয়টি আদালতের নজরে আনতে হবে। এরপর হয়তো আদালত বিবেচনায় নেবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, কেউ প্রতারিত হলে সে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা করতে পারে। তবে এর আগে একটি আইন করা দরকার। কারণ ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে পৃথক কোনো আইন দেশে নেই।

এক যুগের বেশি সময় ধরে নানা প্রতিষ্ঠানের নামে এ ধরনের প্রতারণা চলছে। এরপরও দীর্ঘ দিনেও দেশে এসংক্রান্ত আইন তৈরি হয়নি। যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুসহ ২৮০টি প্রতিষ্ঠান মানুষের ২১ হাজার ১৭ কোটি টাকা লোপাট করেছে। কিন্তু কারও টাকা আদায় বা ফেরত পেয়েছে বলে কোনো উদাহরণ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ায় এমনটি হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত কোনো গ্রাহক প্রতারকদের বিরুদ্ধে টাকা ফেরত চেয়ে আদালতে মামলা করেননি। তদন্তকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় মামলা করেছে। যেমন, যুবকের ঘটনায় গঠন করা কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত ও গ্রাহকদের দাবির ভিত্তিতে তৈরি। এর মধ্যে ২০০৬ সালে যুবকের ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ইউনিপেটুইউ-এর ৬ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ডেসটিনির ৫ হাজার কোটি এবং ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৬৬টি সমবায় সমিতি গ্রাহকদের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ কাতারে সর্বশেষ যোগ হয়েছে ইভ্যালি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিযোগী কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, কোনো কোম্পানি বাজারে অস্বাভাবিক কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারে না। প্রতিযোগী আইনে এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আছে। এজন্য তারা ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো গ্রাহকের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে নতুন করে আইনের আওতায় আনা যাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের (ইভ্যালি) মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা শেয়ারহোল্ডার হিসাবে চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল কোম্পানিকে দিয়েছেন। বাকি ৫৪৩ কোটি টাকা হচ্ছে কোম্পানিটির চলতি দায়। দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ আছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সব মিলে ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে। মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা থেকে স্থাবর সম্পত্তি ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বাদ দিলে বাকি থাকে ৪৩৯ কোটি টাকা। এটিকে অস্থাবর সম্পত্তি বলছে ইভ্যালি। বিবরণী মেলাতে ইভ্যালি দেখিয়েছে, অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা হচ্ছে তার ব্র্যান্ড মূল্য, ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হচ্ছে অদৃশ্যমান সম্পত্তি।

ইভ্যালির কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ ও মুনাফা মিলে মোট আয় বা সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এই টাকার বড় অংশ ব্র্যান্ড ভ্যালুর নামে ব্যয় খাতে প্রদর্শন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকৃত অর্থে ইভ্যালির ব্র্যান্ড ভ্যালু এত বেশি নয়। এই কৌশলে গ্রাহকের টাকা নিজের হিসাবে নিয়ে তারা প্রতারণা করেছে। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে ইভ্যালির সিইও রাশেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর মামলা হয় । এতে শনিবার থেকে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

এদিকে রিমান্ডে তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ মূলত কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছে। সেগুলো হলো-গ্রাহকের কাছ থেকে কী পরিমাণ অর্থ নেওয়া হয়েছে, সেই অর্থ এখন কোথায় আছে এবং আত্মসাৎ করা হয়েছে কি না। রিমান্ড সূত্র জানায়, এসব বিষয়ে এক টেবিলে মুখোমুখিও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এই দুজনকে।

জিজ্ঞাসাবাদে ইভ্যালির অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ টাকা রয়েছে বলে জানা গেছে। রিমান্ডে রাসেল দাবি করেন, তিনি কোনো অর্থ আত্মসাৎ করেননি। গ্রাহকের অর্থ ভেন্ডরকে (বিক্রেতা) দেওয়া হয়েছে। সেগুলো দিয়ে ভেন্ডর গ্রাহককেই পণ্য দিয়েছেন। টাকা নেওয়া এবং অর্থ আদায় ছিল একটি চলমান প্রক্রিয়া।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ওহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েক দফায় তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যেহেতু প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা, সেজন্য আমরা এ বিষয়গুলো সামনে রেখেই তদন্ত করছি। জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে। তবে গ্রাহকের অর্থ কোথায় গেছে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। এটি কয়েকটি ধাপে দীর্ঘ তদন্তের বিষয়। তদন্ত অব্যাহত আছে। সব ধাপ অতিবাহিত হওয়ার পর এ বিষয়ে বলা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে গ্রেফতারের পর র‌্যাবও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেখানেও গ্রাহকের অর্থ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি রাসেল দম্পতি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাসেলকে উদ্ধৃত করে র‌্যাব জানায়, এক হাজার কোটি টাকার মতো ঋণের দায়ে ডুবে আছে ইভ্যালি। অথচ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা আছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা।

বর্তমানে লাখ লাখ গ্রাহক তাদের টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছে। কিন্তু কেউ তাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এ অবস্থায় কিছুটা আশার বাণী শোনাচ্ছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। সংস্থাটি সারা দেশে ভোক্তা অধিকার ও ভোক্তার স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে । এ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ইভ্যালির গ্রাহকরা আমাদের কাছে আবেদন করলে বিষয়টি দেখা হবে। ইভ্যালি সম্পর্কে পুরোনো কিছু অভিযোগ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আর নতুন করে কেউ অভিযোগ দিলে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।

ইভ্যালিকে নিয়ে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ই-কমার্সে যারা প্রতারণা করবেন, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সচিবালয়ে তার দপ্তরের সভাকক্ষে বলেন, ই-কমার্স কোম্পানির লোভনীয় অফার দেখে বিনিয়োগ করা যাবে না। তিনি বলেন, আগে ভেবে দেখতে হবে এ ধরনের বিনিয়োগে কোনো ঝুঁকি আছে কি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলতে চাচ্ছি নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। যেমন, যে গাড়ির দাম ১০০ টাকা, সে গাড়ি ৫০ টাকায় অফার করা হচ্ছে। এসব আকর্ষণীয় অফার বাস্তবসম্মত কি না, তা যাচাই করে অর্থলগ্নির কথা বলছি আমরা, যাতে কেউ প্রতারিত না হয়। প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু, সেটিও যাচাই করে যেন ইনভেস্ট করা হয়। জনগণকে এই বার্তাই দিতে চাচ্ছি আমি।’

মন্ত্রী বলেন, ইভ্যালির মতো আরও কয়েকটা প্রতিষ্ঠান আছে। যারা মানুষের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছে। কীভাবে তারা তাদের কমিটমেন্ট পূরণ করবে, এটা আমার এখন জানা নেই। আমরা মনে করি, তারা যে কমিটমেন্ট জনগণকে দিয়েছে, তা যদি পূরণ না করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১২ জনের বিরুদ্ধে আরেক মামলা : এদিকে ইভ্যালির কর্ণধার মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে। প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শুক্রবার দায়ের করা মামলায় তাদের দুজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডও চাওয়া হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১০-১৫ জনকে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ধানমন্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী। তিনি বলেন, রাসেল ও শামীমা গুলশান থানার মামলায় রিমান্ডে রয়েছেন। ধানমন্ডি থানার মামলায়ও তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।

মামলার বাদী কামরুল ইসলাম চোকদার এজাহারে অভিযোগ করেন, চুক্তির মাধ্যমে তার চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে ইভ্যালিকে মোট ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকার পণ্য সরবরাহ করা হলেও দাম পরিশোধ করা হয়নি। এসব পণ্যের দাম বাবদ ইভ্যালি চেক ইস্যু করলেও সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তা দুইবার ফেরত আসে। রাসেল ও ইভ্যালি চেয়ারম্যান শামীমা ছাড়া মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট আকাশ (৩৫), ম্যানেজার জাহেদুল ইসলাম (৩৫), জ্যেষ্ঠ অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার তানভীর আলম (২৫), সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (কমার্শিয়াল) জাওয়াদুল হক চৌধুরী (৩৫), হেড অব অ্যাকাউন্টস সেলিম রেজা (৩৫), অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার জুবায়ের আল মাহমুদ (৩৫), হিসাব বিভাগের সোহেল (২৫), আকিবুর রহমান তূর্য (২৫), সিইও রাসেলের পিএস মো. রেজওয়ান (২৮) ও বাইক ডিপার্টমেন্টের সাকিব রহমান (৩০)।

ডায়ালসিলেট/এম/এ/

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *