ডায়ালসিলেট ডেস্ক;:বিজয়ের মাসে রচিত হলো আরেক বিজয়ের ইতিহাস। প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড়কে যুক্ত করে পদ্মা সেতু জানান দিলো সাহস আর উদ্যমের নতুন এক উচ্চতা। সব শঙ্কা, সংশয় কাটিয়ে গতকাল রচিত হলো পদ্মা জয়ের গল্প। দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে একে একে ৪১টি স্প্যানে ভর করে দৃশ্যমান হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটারের পুরো সেতুর কাঠামো। এখন একটি একটি করে রোড আর রেলওয়ে স্লাব যুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে দেশে যোগাযোগের এই বৃহৎ বিনিসূতোর মালা। ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের নতুন দিগন্তের সূচনা করবে পদ্মা সেতু। বৃহস্পতিবার কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বসানো হয়েছে সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি। আর এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ব্যয়বহুল ও চ্যালেঞ্জিং সেতু ক্লাবের তালিকায় যুক্ত হলো বাংলাদেশ।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন করে জানান দিলো নিজের সক্ষমতার।
সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর পর এখন এক সময়ের স্বপ্নের সেতু দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে। পদ্মার তীর থেকে দেখা যায় পিলারের দীর্ঘ সারি। তার উপর একে একে বসানো হয়েছে ইস্পাতের কাঠামো (স্প্যান)। পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের জানান, ৪১তম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মার দুই পাড় যুক্ত হলো। গতকাল সকাল থেকেই মাওয়া ঘাটে ভিড় জমাচ্ছিলেন সংবাদকর্মীরা। সংবাদকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহের কমতি ছিল না। পাড় থেকেই দেখা গেছে, তাদের উচ্ছ্বাস। একেক করে সংবাদকর্মীরা ভাড়ায় চালিত ট্রলারে করে পাড়ি জমিয়েছেন সর্বশেষ স্প্যান স্থলে। স্প্যানটি সাজানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা দিয়ে। স্প্যানের গায়ে চীনা ও বাংলা হরফে লেখা হয়, ‘তিন বছরের  প্রচেষ্টায় দেশি ও বিদেশি শ্রমশক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবায়নের পথে। সেতুর ৪১টি ইস্পাতের তৈরি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখবে। তবে শেষ স্প্যান বসানো উপলক্ষে সেতু কর্তৃপক্ষের বাড়তি কোনো আয়োজন ছিল না। বরং জমায়েত এড়াতে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল প্রশাসন। কেবল সেতুর কাছে যেতে পারবেন সরকারের অনুমোদিত লোকজন আর গণমাধ্যমকর্মীরা। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই কর্মযজ্ঞ চলছিল।  সর্বশেষ স্প্যানটি ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটিতে তোলার কাজ শুরু হয় সকাল থেকেই। ঠিক বারোটার দিকে সম্পন্ন হয় স্প্যান বসানোর কাজ। ফলে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে মাদারীপুরের জাজিরা পর্যন্ত পুরো সেতুই এখন দৃশ্যমান। আর মাত্র ক’টা দিন। উদ্বোধনের পর থেকেই শুরু হবে স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার  প্রতিযোগিতা। সময়কে উপেক্ষা করে সেতু দিয়ে ছুটবে বাস, ট্রাক, ট্রেনসহ যানবাহন। সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

এতে মোট  দেশজ উৎপাদন  প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) ১ থেকে  দেড় শতাংশ বাড়বে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। নতুন করে গড়ে উঠবে ভারী শিল্প কারখানা। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে  যেমন  প্রভাব  ফেলবে, সহজ হবে মানুষের চলাচলও। আর এরই অপেক্ষায় যেন বাংলাদেশ।

তবে শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগে সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক আরো তিনটি সংস্থা-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ওই সময়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল  প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। এতে পদ্মার আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। কিন্তু না, থেমে থাকেনি বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। স্বপ্ন পূরণের এই যাত্রা থেমে থাকেনি এক মুহূর্তের জন্য। সব বাধা ঠেলে স্বপ্ন এখন হাতের মুঠোয়। এরকম মেগা প্রকল্পে নিজস্ব অর্থায়ন এই প্রথমবারের মতো। সারা বিশ্বকে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিলো ‘আমরা পারি, পারবো’।

এদিকে গত ৪ঠা ডিসেম্বর ৪০তম স্প্যানটি বসানো হয়েছিল। সেদিনই জানানো হয়, শেষ স্প্যান অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসবে ১০ই ডিসেম্বর। সেই অনুযায়ী নেয়া হয়েছিল প্রস্তুতি। স্টিলের তৈরি স্প্যানগুলোর বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়েছে চীনের কারখানায়। পরে সেগুলো জোড়া দিয়ে ১৫০ মিটারের আকার করা হয় মুন্সীগঞ্জের কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। সেখানে স্প্যান জোড়া লাগানোর পাশাপাশি রঙ করে পাঠানো হয় সেতুর কাছে। তিন হাজার দুইশ’ টন ওজনের একেকটি স্প্যান কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে সেতু পর্যন্ত টেনে নিয়ে  যেতে কাজে লাগানো হয় তিন হাজার ৭০০ টন ক্ষমতার বিশাল একটি  ক্রেন। এতো শক্তিশালী  ক্রেন দুনিয়াতে আছে অল্প দুই একটিই। এই ক্রেনটি তৈরি করা হয়েছে শুধু পদ্মার স্প্যান বসানোর জন্য।

পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোতে থাকছে কংক্রিট ও স্টিল।  সেতুর উপরের অংশে তৈরি হচ্ছে সড়ক পথ। সেতুর সড়ক তৈরির কাজে  প্রয়োজন হবে দুই হাজার ৯২৭টি রোড স্লাব। গত  ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত বসিয়েছে এক হাজার দু’টি স্ল্যাব। এদিকে থেমে নেই নিচ তলায় রেলপথ নির্মাণ কাজ। সেতুর নিচতলায় দেখা যায়, লোহার রডের কাঠামো তৈরি করে দেয়া হয়েছে কংক্রিটের ঢালাই। সেগুলো ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছেন শ্রমিকরা। দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতুটির জন্য শুরু  থেকে অর্থায়ন জটিলতা ছাড়াও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ  মোকাবিলা করতে হয়েছে। সবচেয়ে জটিল হয়ে দাঁড়ায় মাটির নিচের গঠনজনিত জটিলতা। ৪২টি পিলারের মধ্যে ১৪টির নকশা পাল্টাতে হয়েছে। সেটির সমাধানও হয়েছে অভিনব উপায়ে।

যেভাবে এগিয়েছে কাজ: ২০১৪ সালের ৭ই ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর  প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা  সেতুর মূল কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখন ২০১৮ সালের মধ্যে  সেতুর নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়। কাজ পায় চীনের ঠিকাদারি  প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তাদের সঙ্গে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কাজ শুরুর পরের বছরই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের  বেচিং প্ল্যান্টসহ একাংশ নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালের ৩০শে  সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে শুরু করে পদ্মা  সেতু। শুরুর দিকে স্প্যান বসানোর সময়  লেগেছে বেশি। এক কিলোমিটার দৃশ্যমান হতে সময় লেগেছে দেড় বছর। ২০১৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি সপ্তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেতুর এক কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়। ওই বছরের ২৯শে জুন ১৪তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেতুর দুই কিলোমিটারের কিছু বেশি দৃশ্যমান হয়। ২০২০ সালের ১লা জানুয়ারি ২০তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়  সেতুর তিন কিলোমিটার। পরের এক কিলোমিটার দৃশ্যমান হতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে করোনা পরিস্থিতির কারণে। মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সেতুর চীনা কর্মীদের একটি অংশ দেশে ফিরে যান। তখন সেতুর কাজ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। তবে অক্টোবর থেকে সেতুর কাজে আবার গতি আসে। তখন  থেকে  প্রতি সপ্তাহেই একটি করে স্প্যান বসানো হতে থাকে। গত ২৫শে অক্টোবর ৩৪তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেতুর পাঁচ কিলোমিটারের বেশি দৃশ্যমান হয়। বাকি সময়ে বসেছে পরবর্তী ১০টি স্প্যান।

ব্যয়: ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা  সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর  প্রকল্প  প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারো ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *