চা শ্রমিক দিবস। যুগ যুগ ধরে চা শ্রমিকরা এ দিবসটি পালন করে আসছেন এবং তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরছেন। এবারও শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা বাগানগুলোতে দিবসটি পালিত হচ্ছে। চা শ্রমিকরা এবার ভূমি অধিকার ও চা শ্রমিক দিবসের স্বীকৃতি, মজুরী বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি ঘোষণা করেছেন।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

তাদের চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু চা-শ্রমিকরা সব নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। এখনো জীবনমানে পিছিয়ে চা-শ্রমিকরা। বাংলাদেশের অন্যান্য আর্থিক খাতে মজুরি চা-শ্রমিকদের আর্থিক মজুরির অন্তত তিন গুণ। সরকার গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে থাকে। বর্তমানে দেশে ৩১টি শিল্প খাত এরই মধ্যে সর্বনিম্ন মজুরি হলো চা-শিল্পে।  এত অল্প মজুরিতে আর কোনো শিল্পে কর্মরত নেই কোনো শ্রমিক।

চা-শ্রমিকরা কী করে এত কম মজুরিতে কাজ করে পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ৫০ বছরের হলেও চা-শ্রমিকদের শ্রমের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। বছরের পর বছর ধরে এসব চা বাগানে কর্মরত লক্ষাধিক চা-শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এখনো তাদের মজুরি বৈষম্যসহ নানা বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। প্রায় দুইশ বছর ধরে চা-শ্রমিকদের ঘামে শ্রমে প্রতি বছর চা উৎপাদনরে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও তাদের ছেড়ে যায়নি দরিদ্রতা। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাগানে যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশই নারী শ্রমিক। কিন্তু তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি। স্বল্পমজুরি, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, শিক্ষার অভাব অপুষ্টি আর রোগের শিকার চা বাগানের নারী ও শিশুরা।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে কর্মরত চা-শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ ভাগের ওপরে নারী চা-শ্রমিক রয়েছেন। আর এই চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সাত লাখ। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বড় সমস্যা হলো নারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাধার মুখে পড়তে হয়। একেকটি সেকশনে বৃষ্টির সময় ছাউনি থাকে না। ফলে বৃষ্টি গায়ে মেখেই কাজ করাতে গিয়ে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে ভুগতে হয়। তারা যেটা চান সেটা হচ্ছে তাদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময় এখন তারা যে টাকা পান সেটি দিয়ে না ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন, না নিজেরা ভালো কিছু খেতে পারেন।২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম জরিপটি চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই জরিপে দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বাকার, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়। স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কিশোরীর, মা হয়ে যাচ্ছে ২২ শতাংশ। এ ছাড়া ন্যূনতম স্যানিটেশন-সুবিধা নেই চা বাগানের ৬৭ শতাংশ পরিবারের। এর আগে ২০১৮ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোর নারীদের ওপর একটি গবেষণা চালায়। এতে দেখা যায়, প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যানসারে ভুগছেন। ভূমি অধিকার প্রদান এবং জীবন চলার উপযোগী করে বেতন বৃদ্ধি এখন চা-শ্রমিকদের প্রধান দাবি।চা-শ্রমিকের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, ওড়িশা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু দরিদ্র আদিবাসীকে ট্রেনে করে নিয়ে আসে সিলেট অঞ্চলে। এরপর তাদের নিয়ে শুরু হয় পাহাড়-জঙ্গল পরিষ্কার করে চা-গাছ রোপণসহ নানান কাজ। চা বাগান করতে গিয়ে হিংস্র প্রাণীর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসাব নেই। ভূমিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হলেও বাস্তবে ঘটে ভিন্ন ঘটনা! বাগান শ্রমিকদের অত্যধিক খাটানো হতো, তাদের বাসস্থান নিম্নমানের এবং মজুরি ব্রিটিশ মালিকদের মুনাফার তুলনায় খুবই নগণ্য।ভূমি তো নয়-ই, সামান্য বাসস্থানের ব্যবস্থাটাও নিজেদের করে নিতে হয়। এ ছাড়া ব্রিটিশদের জুলুম তো ছিলই। তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা-শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরণ ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুর-মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান।তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ সেনারা গুলি চালিয়ে শত শত চা-শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা- শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করছেন চা-শ্রমিকরা।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *