ডায়ালসিলেট ডেস্ক:: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী আজকের দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন।অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় বিধান সভার সদস্য আব্দুর রশিদ চৌধুরী এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য সিরাজুন নেছা চৌধুরীর পুত্র হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন সিলেট শহরের দরগা গেইটের রশিদ মঞ্জিলে।তাঁর আদি নিবাস সুনামগঞ্জের দরগাপাশা গ্রামে। তিনি একজন মহৎপ্রাণ প্রশাসক, দূরদর্শী জনপ্রতিনিধি, প্রজ্ঞাবান কুটনীতিবিদ ও উন্নয়নকামী রাজনীতিবিদ।মেধা, দায়িত্বশীলতা, উদারতা, বাগ্মীতা, সৌজন্যবোধ আর প্রখর ব্যক্তিত্ব তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এক সম্মোহনী সুপুরুষে।কসবে সিলেটের সন্তান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মর্যাদাকে করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার হাই মাদ্রাসা সেকশনে প্রাথমিক শিক্ষা ও আসামে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৪৭ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তারপর ইংলিশ বারে অধ্যয়ন করেন ও লন্ডনের ইনার টেম্পলের একজন সদস্য হন। লন্ডনেরই ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠান’ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও, ম্যাসাচুসেটসের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপে পাকিস্তান ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন। সে সুবাদেই তিনি যুক্তরাজ্যে প্রথম এশিয়ান স্টুডেন্টস কনফারেন্স আয়োজনে সক্ষমতা দেখান।

১৯৫৩ সালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে কূটনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযোদ্ধা কূটনৈতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ অধিবেশনে ভাষণ দেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে ৪০টিরও অধিক দেশের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত হন। ১৯৭৬ সালের পর সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং ভ্যাটিকানেও একই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ এবং জাতিসংঘের শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন সংস্থা বা ইউনিডো’র প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি তিনি ছিলেন । ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই তিনি জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে  হত্যা করার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার জার্মানীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জামাতা ড. ওয়াজেদ ও দুই নাতি-নাতনিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি একাধারে রাষ্ট্রদূত,পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রসচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য এবং সব শেষে মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেট-১ ও সুনামগঞ্জ -৩ আসন থেকে ১৯৮৬ সালে  সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে সিলেট ১ আসন থেকে ১৯৮৮ সালে ৪র্থ সংসদ এবং ১৯৯৬ সালে ৭ম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই তিনি সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি সিলেটের অঞ্চলের এখন পর্যন্ত প্রথম ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের অন্যতম সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

সিলেটের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য লালনে তিনি ছিলেন যত্নশীল। শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সবচেয়ে বড় অবদান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।সিলেট শিক্ষা বোর্ড, সিলেট টিচার্স ট্রেনিং  কলেজ, আধুনিক রেলওয়ে ষ্টেশন, পূর্ণাঙ্গ আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে রানওয়ে সম্প্রসারণ তাঁরই উদ্যোগ। সিলেট শহরের বাইপাস সড়ক, টুকেরবাজার এলাকায়  সুরমা নদীতে সেতুসহ বাইপাস সড়ক, বাদাঘাট সেতু এগুলো তাঁর দূরদর্শী উনয়ন পরিকল্পনার অংশ।সিলেটে সুরমা নদীতে তিনি একটি ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।যা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন হয়ে অন্যভাবে কাজীরবাজার সেতু নামে বাস্তবায়ন হয়েছে।

তাঁর নির্বাচনী এলাকার পশ্চাৎপদ  কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাকে তিনি উন্নয়নের আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। সুনামগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য থাকার সময় জগন্নাথপুর কলেজ স্থাপন, দুটি উচ্চ  বিদ্যালয়কে সরকারিকরণসহ সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি গ্রহণ করেছিলেন মহাপরিকল্পনা। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কৌশলের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

১৯৯৬-২০০১ সালে তিনি জাতীয় সংসদের স্পীকারের দায়িত্ব পালন করার সময় দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশে পালন করেন যুগান্তকারী ভূমিকা।

খ্যাতিমান কূটনীতিক হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী প্রবাসে বিশেষ করে সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার চালু করতে অসামান্য অবদান রাখেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারি থেকে ১৯৮৪ সালে ‘মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ পান। বিশ্ব শান্তিকল্পে অনবদ্য কূটনৈতিক ভূমিকার জন্য তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি ‘উ থান্ট শান্তি পদক’ লাভ করেছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।[১০] এছাড়াও তার সম্মানে ঢাকা থেকে সিলেট শহরের প্রবেশপথে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে ‘হুমায়ূন রশীদ চত্বর’।

হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ১০ জুলাই ২০০১ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। সিলেটের শাহজালালের মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে।

সিলেট দরদী এই মানুষটি ছিলেন একজন উন্নত রুচির মানবিক পুরুষ। অত্যন্ত সজ্জন এ বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন একজন খাঁটি সিলেটবন্ধু। মহান এ কর্মীপুরুষের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *