ডায়াল সিলেট ডেস্ক :: মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের বর্ষব্যাপী চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘পঞ্চাশে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক ধারাবাহিক গোলটেবিল বৈঠকে সুধীজন অভিমত রেখেছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলন করতে পারিনি। আমাদের নতুন প্রজন্ম ক্রমেই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ দায় যেমনি রাষ্ট্রের তেমনি অভিভাবক, পরিবার এবং সমাজের। তবে এই উপলব্ধির ভিত্তিতে আজকের এই আয়োজনের মতো ছোট ছোট উদ্যোগ আমাদেরকে আশার আলো দেখায়।
গত সোমবার রাতে সিলেট নগরীর পূর্ব জিন্দাবাজারে (বারুতখানা) সিলেট জেলা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আল আজাদ। স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক ছামির মাহমুদ।
আলোচ্যসূচি ছিল- গত ৫০ বছরে সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলন, দেশে-বিদেশে বাংলা চর্চা, আঞ্চলিক ও বিদেশী শব্দের ব্যবহার এবং উচ্চারণ ও প্রচলিত বানানরীতি। প্রায় দুই ঘণ্টার এই বৈঠকে অতীতের প্রাপ্তি ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা করেন, অতিথি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকা, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার, লেখক ও গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী, মদনমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হোসনে আরা কামালী, ব্লাস্টের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সাবেক শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা গল্পকার মাহবুবুজ্জামান চৌধুরী, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক বালাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ লিয়াকত শাহ ফরিদী, প্রবাসী লেখক শেখ নুরুল ইসলাম, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ফৌজিয়া আক্তার ও সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের নির্বাহী সদস্য রেজওয়ান আহমদ।
এছাড়া প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেন, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সহ-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রাসেল, কোষাধ্যক্ষ মিসবাহ উদ্দীন আহমদ, কার্যনির্বাহী সদস্য মিঠু দাস জয়, সদস্য ইয়াহ্ইয়া মারুফ, আশরাফ আহমদ ও পল্লব ভট্টাচার্য্য।
শাবিপ্রবি বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দীকা বলেন, ভাষার মান উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষায় বাংলা একাডেমিকে আরও যত্নশীল হতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যম যেনো নিজস্ব বানারীতি চালু করতে না পারে। বানানরীতি হবে সার্বজনীন। এজন্যে বাংলা একাডেমিকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। ভাষার বিকৃতি ঘটাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে চিহ্নিত একটি রাজনৈতিক দল। এর অংশ হিসেবেই বিদেশী ভাষায় নিজেদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, দেশের অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে দেওয়া হচ্ছে।
লেখক ও গবেষক মিহিরকান্তি চৌধুরী বলেন, বাংলা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার শেখার জন্যে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি (কোর্স) নেই। জরুরিভাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তা চালু করা প্রয়োজন। এটি ছয় মাসের এমনকি ডিপ্লোমা কোর্সও হতে পারে। গবেষণা ও অনুবাদ কাজে ভাষার ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকতে হয়। বানান নিয়ে এখনও ভিন্ন ভিন্ন মত বিদ্যমান রয়েছে।
মদনমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হোসনে আরা কামালী বেসরকারি বেতার-টেলিভিশনে বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে কিছু শব্দ ও বাক্যের উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাপান ও চীনের মতো দেশ নিজেদের ভাষাকে সর্বস্তরে নিয়ে গেছে। এসব দেশে ইংরেজির তেমন গুরুত্ব নেই। আর বাংলাদেশে রক্ত দিয়ে ভাষা রক্ষা করলেও ভাষার মর্যাদা ধরে রাখা যাচ্ছে না।
ব্লাস্টের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতারগুলো ভাষার বিকৃতি ঘটাচ্ছে। আদালতে ব্যবহৃত হচ্ছে দুটি ভাষা। নিম্ন আদালতে বাংলা আর উচ্চ আদালতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইংরেজি। তবে আদালত সংশ্লিষ্ট সকলের মনোজগতে আশানুরূপ পরিবর্তন এসেছে।
গল্পকার মাহবুবুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মানুষ ক্রমশ নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি। সবকিছুই বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। আগের মতো বলার বা শেখানোর মানুষও নেই।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অধ্যক্ষ লিয়াকত শাহ ফরিদী বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়া দুঃখজনক। শিক্ষকরাও ঠিকমতো শেখাতে পারছেন না। নেপথ্যের কারণ হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের কর্মজীবনে প্রবেশকালীন প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকা। অথচ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কর্মজীবনের শুরুতে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক রয়েছে।
প্রবাসী লেখক শেখ নুরুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক বাংলা পত্রিকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেগুলো বাংলা চর্চায় নতুন প্রজন্মকে সুযোগ করে দিচ্ছে। তাই বাংলা ভাষা হারাবে না। তবে প্রতিনিয়ত বিকৃতি ঘটছে। এটা রোধ করতে ভাষার ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে।
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ফৌজিয়া আক্তার বলেন, আমরা সন্তানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও ব্যর্থতা রয়েছে। সবাই পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার্থী চাইছি। শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন না। কেউ করলে অন্যরা হাসি-ঠাট্টা করেন।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!
0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *