ডায়ালসিলেট ডেস্ক::মানবসেবার ব্রত নিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়তে এলেও বিভিন্ন সময় স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কাগজে-কলমে বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রায় কেউই তা মানছে না। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কলেজ ক্যাম্পাসে সক্রিয়। এরসঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

এদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন সংঘাতে। এতে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে স্বার্থ ও সংঘাত এ দুইয়ের কবলে পড়ে ভবিষ্যতে যোগ্য চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ঘোলাটে হয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে মুগদা মেডিকেল কলেজের সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, মেডিকেল ছাত্রদের উদ্দেশ্য হবে মানুষের কল্যাণে কাজ করা। লেখাপড়া করে দক্ষ চিকিৎসক হওয়ার প্রতিযোগিতা করা। কিন্তু দিন দিন তাদর মধ্যেও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে। এগুলো আমাদের সেবার মতো মূল জায়গা থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মেডিকেল শিক্ষায় আরও বেশি জোর দেওয়া। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেডিকেল ইথিকস মেইনটেইন, নীতিবোধ জাগ্রত ও নৈতিকতার চর্চা বড়াতে হবে। শিক্ষার্থী নিজে, তার পরিবার, কলেজ কর্তৃপক্ষ, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে এ ব্যাপারে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে।

দেশের ৩৬টি সরকারি হাসপাতালে নানা সময়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হচ্ছে। এজন্য সবসময় প্রতিপক্ষ হিসাবে অন্যদলের প্রয়োজন হয় না। একই দলের দুগ্রুপের মধ্যেও সংঘর্ষ হচ্ছে হরহামেশা। এতে মেধাবী অনেক শিক্ষার্থীর জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। কেউ গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘ চিকিৎসা নিচ্ছেন। সম্প্রতি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক)। চট্টগ্রাম মহানগরে শাসক দলের এক নেতার অনুসারীরা প্রায় ৩৩ বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে চমেক। এ অধিপত্য খর্ব করে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় দুই বছর আগে থেকে সক্রিয় অপর এক নেতার অনুসারীরা।

এ দুবছরে অন্তত ৮-১০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে বিবদমান দুটি গ্রুপ। সর্বশেষ ২৯ ও ৩০ অক্টোবর তিন দফা সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন। এ সময় মাথায় গুরুতর চোট পান এমবিবিএস ৬২তম ব্যাচের মাহাদী জে আকিব। চিকিৎসকরা তার মাথার খুলি অস্ত্রোপচার শেষে সাদা ব্যান্ডেজে জুড়ে সেখানে লিখে দেন, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিচে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় দুপক্ষ থানায় পৃথক তিনটি মামলা করে। এসব মামলায় প্রায় ৪০ জনকে আসামি করা হলেও গ্রেফতার হয়েছে মাত্র দুজন। এছাড়া অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধের পর ২৭ নভেম্বর খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে।

চমেকে দুগ্রুপের সংঘর্ষের পর ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা গেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) সক্রিয়। এটি এক নেতার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে। এ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ১৫ নভেম্বর অপর নেতার অনুসারীরা ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ (ইচিপ) নামে নতুন কমিটি গঠন করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, পালটাপালটি কমিটির কারণে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর চমেক ছাত্রাবাসে পিটুনির শিকার হয়ে মারা যান আবিদুর রহমান আবিদ। তিনি ‘ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি’ তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বজনদের অভিযোগ, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চেষ্টা করায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা কয়েক দফা পিটিয়েছিলেন আবিদকে। ওই নির্যাতনের দুদিন পর ২১ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবিদ। বারবার সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও তা কেউ মানছে না। সর্বশেষ চলতি বছরের ২ মার্চ মারামারির ঘটনায় দ্বিতীয় দফা রাজনীতি নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার  বলেন, মেডিকেলে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা স্বার্থের রাজনীতি বা মারামারিতে জাড়াচ্ছে যা খুবই দুঃখজনক। যারা হিউম্যান বিং নিয়ে কাজ করবে, তাদের উগ্র মানসিকতা অবশ্যই খারাপ। এ ব্যাপারে ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্টরাসহ সমাজ, রাজনৈতিক নেতা, যারা আড়ালে থেকে প্রশ্রয় দেয় কেউই দায় এড়াতে পারে না। মূলত ক্যাম্পাসের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। ফলে মেডিকেল কারিকুলামে বিহেভিয়ারাল কোর্স যুক্ত জরুরি হয়ে পড়ছে। যাতে রোগীর সঙ্গে আচরণ শেখা ছাড়াও নিজেদের নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতন হবে।

২১ নভেম্বর ক্রিকেট খেলা নিয়ে গোপালগঞ্জে শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ইটের আঘাতে সদর থানার ওসি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও সংবাদকর্মীসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন।

চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে ছাত্রলীগের সাবেক নেতার ওপর নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সহপাঠীদের হাতেই নির্মমতার শিকার হন এএসএম আলী ইমাম নামে এক ইন্টার্ন চিকিৎসক। তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে কলেজ ছাত্রলীগ এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতারা জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। ওই শিক্ষার্থী সেদিন বেঁচে ফিরলেও জীবন রক্ষায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার শিক্ষাজীবন।

২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে একটি ছাত্র সংগঠনের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় ক্যাম্পাস সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কর্তৃপক্ষ ২৬ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে একাডেমিক কার্যক্রম ও ছাত্রাবাস থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে সভা, সমাবেশ, মিছিল, ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন লাগানোসহ সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বর্তমানে তারা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট খুলনা মেডিকেল কলেজে দুপক্ষের সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। সংঘর্ষে জড়িত চার শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। সংঘর্ষের ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়।

ডায়ালসিলেট এম/

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *