ByDialSylhet

ফেব্রু ২৭, ২০২১

এমরান ফয়সল;:

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

প্রথম ছবিটার দিকে প্রথম চোখ রাখুন। ভালো ভাবে দেখুন। ছবিটাকে চোখ থেকে মুছে দিলে দেখা যাবে একটি কাষ্ঠখন্ড। কোন এক পুরাতন দরজার কোন এক পাটাতন থেকে খসে পড়েছে এটি। এটি কারো চুলায় জ্বলে পুড়ে খাবার প্রস্তুত করে দিতে পারতো, নয়তো খালে বিলে নদী নালায় ভেসে কোন অজানায় চলে যেতে পারতো। কিন্তু এর কোনটাই হয়নি। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই কাষ্ঠখন্ডটি আজ শিল্পমান পেয়েছে এক শিল্পীর তুলির আঁচড়ে।
সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার বোয়ালিয়া বাজারের ধীতপুর গ্রামের স্বর্গীয় নরেশ চন্দ্র দাস মহাশয়ের প্রতিভাধর পুত্র নলিনীকান্ত দাস। বাবার শিল্প প্রতিভায় আকৃষ্ট ও বাবার শিল্পসৃষ্টির সহযোগি হয়ে তিনি এ গুণগুলো নিজের আয়ত্বে, নিজের মননে ধারণ করেছেন। ধীতপুর গ্রামের আলোকিতজন নলিনীকান্ত দাস শিল্পগুণ, মেধা ও মননে ধারণ করেছেন শৈশব থেকেই।
নরেশ চন্দ্র দাস নিজেও একজন চিত্রকর ছিলেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি আঁকতেন, নিজের সৃষ্টিশীল চিন্তা চেতনায় বাঁশ, কাগজ ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে নানান রকম জিনিস তৈরী করতেন, বিয়ের কুঞ্জ বানানো, পূজা পার্বণে আল্পনা আঁকাসহ নানা রকম সাজ সজ্জ্বার কাজ করতেন তিনি। পুত্র নলিনী সাথে থাকতেন নিজের আগ্রহে কাজের সুবিধা ও সহযোগিতায়।
নলিনীকান্ত দাসের জ্যাঠামহাশয় সুরেশ চন্দ্র দাস চাকুরী করতেন সিলেট হেড পোস্টালে সুপারেনটেনডেন্ট হিসেবে। তিনি ১৯৫৪ সালে সিলেট চলে আসেন। তিনি সে সময় বৃহত্তর দিরাই- সুনামগঞ্জ এলাকার প্রথম বা প্রথম দিকের কেউ যিনি সিলেট শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। শহরের রামেরদিঘীর পাড়ে থাকতেন জ্যাঠামহাশয় সুরেশ চন্দ্র দাস।
১৯৬১ সালে নলিনীকান্ত দাস প্রথম শ্রেণির ছাত্র। নির্বোধ বয়স। লেখাপড়া আর খেলাধূলা ছিলো নিত্যকর্ম। অসুস্থ মা সুচিকিৎসার জন্য সিলেট এসেছিলেন বড় বড় নামী দামী চিকিৎসকের তত্বাবধানে শরীরের জরা ব্যাধি দূর করতে। কিন্তু সে না হয়ে তিনিই দূর থেকে বহু দূরে চলে গেলেন একেবারে না ফেরার দেশে।
জ্যাঠামহাশয় সুরেশ চন্দ্র দাস ভাতিজার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে সিলেটে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। তখন ১৯৬২। পাকিস্তান মুল্লুক। নলিনীকান্ত রামেরদিঘীরপাড় এসে ভর্তি হলেন মির্জাজাঙ্গাল পয়েন্টে তৎকালীন মন্দির স্কুলে ক্লাস টুতে। মেঝেতে সব ছাত্র-ছাত্রীরা পা ভাঁজ করে আসন করে বসতেন। ছেলেদের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা সব ক্লাসে নাই বললেই চলে। সহপাঠী, বন্ধু, চলা খেলার সাথী হিসেবে পেলেন এলাকার রাজর্ষী দাস শেখর ও হিটলার দাস সিন্টু নামের আপন দুই ভাইকে। অন্যরা হলেন শ্যামল ভৌমিক, সঞ্জয় পাল সহ আরোও ক’জনকে।
তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন দি এইডেড মাল্টিলেটারেল হাই স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। তাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এএসসি পাশকারী। পরে ১৯৭৪ সালে মদনমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি, এমসি কলেজ থেকে বুটানিতে ভর্তি হয়ে অনার্স পাশ করেন। বুটানিতে নিজের ও সহপাঠীদের ব্যবহারিক খাতা তিনি নিজে এঁকে দিতেন। নলিনীকান্ত দাসের আঁকায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৭৬ সালে এমসি কলেজের শিক্ষক ড. এনায়েত হোসেন স্যার বুটানির শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যবই রচনা করলে সে বইয়ের সব ছবি অঙ্কন স্যারের প্রিয় ছাত্র নলিনীকান্ত দাসকে দিয়ে করান। সেই স্যার আজ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বুটানি বিভাগের ডীন।
নলিনী দাসের প্রতিবেশী ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। নলিনী দাসের রামের দিঘীর পাড়ের বাসার পিছন দিক আর মঞ্জুরুল স্যারের মির্জাজাঙ্গালের বাসার পিছন দিক ছিলো একত্রে। নলিনী দাস ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম স্যারকে মামা, এবং স্যারের মাকে দীদা সম্বোধন করতেন। ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম নলিনী দাসে আঁকা ছবি দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিতে সম্মত হলেও সেই সময়ে ছবি এঁকে জীবন জীবিকার কথা অভিভাবকেরা কেউ ভাবতে না পারায় সে পথে আর নলিনী দাস অগ্রসর হতে পারেননি। তবে ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল স্যার নলিনীকান্ত দাসকে দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য বড় আকারে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ’র ছবি আঁকিয়ে নেন।
নলিনীকান্ত দাস শৈশবে কবিতা লিখেছেন, গান গেয়েছেন, সংগঠন করেছেন। পুরাতন মেডিকেল কলোনীতে কল্পনা বয়েজ ক্লাবের হয়ে মেডিকেল কলেজের অডিটোরিয়ামে বহু নাটক করেছেন। তখন তাদের নাটকের নির্দেশক ও পরিচালক ছিলেন সে সময়ের আলোচিত ফটোগ্রাফার মনির আহমদ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নলিনীকান্ত দাস বলেন, পরিশোধ নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি ডাক্তার চরিত্রের অভিনেতাকে ছুরি দিয়ে মেরে ফেলেন। সেই ডাক্তারের আপন ভাগ্নে তার মামাকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলেছেন ভেবে তিনি দর্শক সারী থেকে কেঁদে মঞ্চে উঠে নলিনীকান্ত দাসকে ধরে ফেলেন। তাদের অভিনয় এতোটা জীবন্ত ছিলো যে দর্শক ভাগান সেটাকে আর অভিনয় মনে করেননি। সে ভাগ্নাও মেডিকেলের ছাত্র ছিলেন।
সিলেটে প্রথমবারের মত এক্সিবিশন হয়েছিলো সিলেট স্টেডিয়ামে “অপরূপা ৭৭” নামে। এরকম আনন্দঘন আয়োজন এর আগে পরে কখনোও হয়নি। সেই আয়োজনে নলিনীকান্ত দাস অনেক স্টলের ডিজাইন ও সাজসজ্জ্বা করে দিয়ে বিরাট সম্মান ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি।দাড়িয়াপাড়ায় নাট্যকার বিদ্যুৎ কর, নাট্যশিল্পী মায়া কর, সুরকার ও সংগীত পরিচালক অঞ্জন দাসের ছত্রছায়ায় তাদের বেড়ে উঠা। ১৯৭৪/৭৫ সালের দিকে ছাত্রাবস্থায় আজকের সিনিয়র আইনজীবি কবিবন্ধু সঞ্জয় কুমার পাল, কবিবন্ধু নিরঞ্জন পুরকায়স্থ (নিপু বুদ্ধ) ও বর্তমানে লন্ডনে বসবাসকারী কবিবন্ধু রুহুল আমিন এই তিন বন্ধুর কবিতা নিয়ে প্রকাশ করার জন্য মূল উদ্যোগ তিনিই নিয়েছিলেন। বইয়ের নাম ছিলো “তিন জোড়া চোখ”। বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন নলিনীকান্ত দাস। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য’র জন্মজয়ন্তি সিলেটে প্রথম তারাই করেছিলেন।
সেই সময়ে অভিজাত হিন্দু বাড়িতে গানের জলসা হত। লোক গানের গুরুপদের আপন দুই ভাই শিল্পী বিদিত লাল দাস পটল, বিজিত লাল দাস আলু গান গেয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। সুরসাগর প্রাণেশ দাসের বড় ছেলে পারিজাত দাস পল্টু খুব ভালো হাওয়াই পিয়ানো বাজাতেন। দ্বিতীয় ছেলে অঞ্জন দাস বাজাতেন গীটার। নলিনীকান্ত পল্টু দাসের হাওয়াই বাজানোয় আর অঞ্জন দাসের গীটার বাজানোয় মুগ্ধ হয়ে নিজে বাজানোর জন্য হাওয়াই পিয়ানো ও গীটার কিনেন। কিন্তু তা আর শেখা হয়নি।
নলিনীকান্ত দাস শিল্পের নানামুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও সংস্কৃতির কোন ধারায় নিজেকে আবিষ্ট রাখেননি। পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্র জীবন কেটেছে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতায়। তিনি ১৯৮১ সালে বনবিভাগে চাকুরীর জন্য পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। চাকুরীর কারণে নানা জেলার নানা অঞ্চলে বসবাস করেছেন। ২০১৫ সালে ফরেস্ট ইনস্টিটিউট থেকে রেঞ্জ অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পেশার চাপে অন্তরে পোষা শিল্পসত্বা কর্পূরের মত উড়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে ছবি আঁকার অদম্য নেশা, অতৃপ্ত বোধশক্তি।
নলিনীকান্ত দাশ এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক। মেয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ছেলে পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হয়ে পিএইচডি করছেন দেশের বাইরে।নলিনীকান্ত দাসের সারা ঘর জুড়ে আছে তাঁরই আঁকা ছবিতে। বাবার ছবি, মেয়ের ছবি সর্বোপরি হবু বধূমাতার ছবিও জীবন্তরূপে এঁকে ঝুলিয়ে রেখেছেন তাঁর ঘরের দেয়ালে। বিছনাকান্দি, জাফলংয়ের জলের বুক থেকে ডুবে আনা পাথরের বুকে রঙ তুলি দিয়ে এঁকেছেন অপসরা আর উর্বশীর অবয়ব। পায়ের তলায় চাপ খাওয়া পাথর তুলির আঁচড়ে হয়েছে শোভিত। কাঠ দিয়ে নিজ হাতে তৈরী করেছেন শৈল্পিক নানান আসবপত্র। কাঠের তৈরী বিষ্ণুর অঙ্গ গঠন করেছেন চমৎকার ভাবে।
নলিনীকান্ত দাশ এখন নানা জনের প্রকাশযোগ্য গ্রন্থের প্রচ্ছদ করছেন। তিনি জীবনের বাকী দিনগুলো ছবি আঁকার মাঝেই অতিবাহিত করতেন চান শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে।

 

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *