সোহেল আহমদ :: প্রভাব বিস্তার, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা কারণে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে টিলাগড়ে। সিলেটে আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেছে টিলাগড়। নগরীর এই এলাকাটি ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। নিজেদের মধ্যে বিরোধ থেকে এই এলাকায় প্রায়ই সংঘাতে জড়ায় ছাত্রলীগ। এতে নিয়মিতই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বেই ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত এখানে প্রাণ হারিয়েছে ৮ ছাত্রলীগ কর্মী। এই হত্যার মিছিলে সর্বশেষ শিকার অভিষেক দে দ্বীপ।

বৃহস্পতিবার রাতে সৈকত রায় সমুদ্রের নেতৃত্বে একদল যুবকের হামলায় অভিষেক দে দ্বীপ নিহত হন। নিহত দ্বীপ গ্রিনহিল স্টেট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। হামলায় নেতৃত্বদানকারী সৈকত সিলেট সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। নিহত দ্বীপ ও অভিযুক্ত সমুদ্র দুজনই আওয়ামী লীগ নেতা রণজিৎ সরকার গ্রুপের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী বলে জানা গেছে।

নগরীর শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাইয়ুম জানান, বৃহস্পতিবার রাতে দ্বীপকে ছুরিকাঘাত করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায় হামলাকারীরা। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া গেলে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পর সৈকতকে আটক করে পুলিশ। সেও আহত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, গত সরস্বতী পূজায় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এমন বিরোধের জের ধরেই বৃহস্পতিবার রাতে হামলার ঘটনা ঘটে।

নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানানো হলেও শুক্রবার বিকেলে নিহত অভিষেকের বাবা দিপক দে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, শুক্রবার পিকনিকে যাবার কথা ছিল ছেলের, কিন্তু আমাকে তার লাশ নিয়ে যেতে হচ্ছে, আর কার কাছে বিচার চাইবো?

মূলত সেখানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সবচেয়ে ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগ দলের শীর্ষ নেতাদের মাঝে আজাদ-রনজিৎ গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত এ ঘটনার পুনরাভিত্তি ঘটতে থাকে যার কারণে প্রতিবছরই মার্ডার হচ্ছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।

এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সিলেটের টিলাগড়ে ছাত্রলীগের গ্রুপিং ও হত্যার রাজনীতি শুরু হয় ২০০৩ সালে।

ওই বছরের ৭ জানুয়ারি খুন হন আকবর সুলতান নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী। একই বছরের ৯ অক্টোবর খুন হন আরেক ছাত্রলীগ নেতা মিজান কামালী। ২০১০ সালের ১২ জুলাই উদয়েন্দু সিংহ পলাশ, ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট করিম বক্স মামুন, ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম, ১৬ অক্টোবর ওমর আহমদ মিয়াদ, ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি তানিম খান এবং সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে খুন হয়েছেন অভিষেক দে দ্বীপ।

কেন ছাত্রলীগের জন্য ডেডজোন হয়ে ওঠেছে টিলাগড় তথা সিলেট। এমন প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, কমিটি নিয়ে টালবাহানা, দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না থাকায় সংগঠনের ভেতর তৈরি হয়েছে নানা উপগ্রুপ।

নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ছাত্রলীগের এসব হত্যাকাণ্ডে বেশিরভাগ সময়ই খুনিরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিহতের পরিবারে বিচারের আশা তাই থেকে গেছে মাতম হয়েই।

সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ বলেন, প্রায় দু বছর ধরে নেই জেলা কমিটি, মহানগর কমিটিও নেই। মানে কমিটি ছাড়াই চলছে সিলেট ছাত্রলীগ। ফলে চেইন অব কমান্ড বলে কিছু নেই। টিলাগড়ে একাধিক বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় ছাত্রলীগ কর্মীদের একটি বড় অংশ এ এলাকায় থাকে। সেখানে যেটা হচ্ছে সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে খুনোখুনি হচ্ছে। এজন্য বাইরের রাজনীতির প্রভাব যেমন থাকতে পারে তেমন অনুপ্রবেশকারীরাও থাকতে পারে। খুনোখুনি থামাতে দ্রুত সিলেট ছাত্রলীগকে গোছাতে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে আহ্বান জানান সামাদ।

টিলাগড় এলাকায় এরকম ৭টি চক্রের কাছে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ৫টি চক্রই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার শেল্টারে। বাকিগুলোতে প্রভাব আছে বিএনপির।

গত ১০ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে টিলাগড় এলাকায় ৪০টির বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিটিতেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। এসব অপকর্ম রোধে কমিটি স্থগিতসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, খুন ছাড়াও অস্ত্রবাজির ক্রমিক ঘটনা ঘটেছে টিলাগড় এলাকায়। ২০১৩ সালের ১৯ মে, ২০১৬ সালের ৭ মার্চ, ২০১৮ ৫ জানুয়ারি টিলাগড় ও এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়ার ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেউ আটক হয়নি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *