প্রকাশিত: ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২১
ডায়ালসিলেট ডেস্ক::জিসান আহমেদ (৪৮) পেশায় ব্যবসায়ী। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকার অভিজাত এলাকায়। মাসখানেক আগে তার মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। রিসিভ করার পর অপর প্রান্ত থেকে সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী এক নারী তাকে সালাম দিয়ে বলেন জিসান ভাই কেমন আছেন? জিসান ভালো আছি বলে ওই নারীকে বলেন আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। অপরিচিত ওই নারী তখন বলেন- সত্যিই চিনতে পারছেন না? একটু চিন্তা করে দেখেন। তারপর জিসান বলেন ও আপনি মিজান ভাবী। ধন্যবাদ দিয়ে ওই নারী বলেন, চিনতে পারার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি খুব বিপদে আছি। আপনার ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এখন জরুরি ভিত্তিতে ৫ হাজার টাকার দরকার। আমি হাসপাতাল থেকে ফিরেই দিয়ে দেবো। জিসান তখন নারীর দেয়া একটি বিকাশ নম্বরে ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর ওই নারী আবার জিসানের নম্বরে ফোন দিয়ে বলেন, ভাই বলতে লজ্জা করছে আসলে দরকার ছিল ১০ হাজার টাকা। আমি ভুলে ৫ হাজার টাকা বলেছি। জিসান ওই নম্বরে আবার ৫ হাজার টাকা পাঠান। কয়েক ঘণ্টা পর জিসানের মোবাইলে আবার ওই নারীর ফোন। লজ্জাজড়িত কণ্ঠে জিসানকে বলেন, বলতে লজ্জা করছে তবুও বলতে হচ্ছে হাসপাতালের বিল দিতে গিয়ে দেখি আরও ৫ হাজার টাকা লাগবে। কোনো অজুহাত ছাড়াই জিসান আরও ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু টাকা পাঠানোর পর বিষয়টি জিসানের সন্দেহ হওয়াতে তিনি তার বন্ধু মিজানের মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। কেউ প্রতারণা করে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে। আর ততক্ষণে মিথ্যা পরিচয় দেয়া ওই নারীর মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু জিসানই নন। সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার বাইরের একাধিক ভিভিআইপি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা ব্যক্তিদের একইভাবে ফোন দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে একটি চক্র। প্রতারিত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ঢাকার। প্রতারিত হওয়ার পর এসব ব্যক্তিরা ঢাকার বিভিন্ন থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম এই প্রতারক চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. আলী আকবর হীরা (৫১) ও মো. শেরে আলী জিতু (২০)। তারা দু’জন সম্পর্কে পিতা-পুত্র। ডিএমপি’র কাফরুল থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম সূত্র জানিয়েছে, হীরা ও জিতু দু’জনেরই মূল পেশা প্রতারণামূলক কাজ করে টাকা আত্মসাৎ করা। প্রতারণা ছাড়া তাদের আয়ের আর কোনো উৎস নাই। অন্তত সাত বছর ধরে বাবা-ছেলে মিলে নারীর কণ্ঠ নকল করে শত শত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের অপরাধের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তারা ই-ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে কোনো পারসোনাল নম্বরে টাকা লেনদেন করতো না। তাদের বাসার আশেপাশের বিভিন্ন এজেন্ট ব্যাংকিং যেমন বিকাশ, নগদের মাধ্যমে লেনদেন করতো। অনেক সময় এজেন্টের কাছ থেকে তাদের পারসোনাল বিকাশ অথবা নগদ নম্বরে টাকা আনতো। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের বাসার আশপাশের ই-ট্রানজেকশন এজেন্টের দোকানগুলোর ক্যাশ আউট স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে এই দুই অপরাধীর অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
সাইবার সূত্র জানায় মো. আলী আকবর হীরা মূলত মোবাইল ফোনের ম্যাজিক ভয়েস ব্যবহার করে নারী কণ্ঠে কল দিতো। আর তার ছেলে শেরে আলী জিতু ভিভিআইপি সিরিয়ালের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতো। নম্বর সংগ্রহ করার সময় জিতু অনেক সময় ব্যবহারকারীর নাম জেনে নিত। আর না পারলে আইএমও অ্যাপ্স দিয়ে কল করার আগে জানতো। নাম সংগ্রহ করে কল করে ওই নাম সম্বোধন করেই কথা বলতো। একেক ব্যক্তির কাছে একেক ধরনের অজুহাতে ফোন দিত তারা। এক কৌশলে টাকা নেয়ার পর কিছুক্ষণ পর আবার কল দিতো। দিনের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন অথবা একই অজুহাত দেখিয়ে তারা টাকা হাতিয়ে নিয়ে যেতো।
ভুক্তভোগী জামাল হোসেন বলেন, আমি একটি বেসরকারি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কিছুদিন আগে দুপুর বেলা আমার মোবাইলে এক নারী ফোন দিয়ে আমার আত্মীয় পরিচয় দেন। আমাদের সব আত্মীয়কে আমি চিনি না। তারপর কুশলবিনিময় করার পর ওই নারী আমাকে বলেন, তার স্বামী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বাসায় বেকার। ঘরে সন্তানেরা না খেয়ে আছে। এছাড়া তার স্বামীর ওষুধের টাকা নেই। কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হবে। তাই ২০ হাজার টাকার দরকার। কয়েকদিন পরে টাকা ফেরত দিবেন। পরে আমি আমার অফিস সহকারীর মাধ্যমে ওই নারীর মোবাইল নম্বরে ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেই। দু’দিন পর ওই নারী আবার ফোন দিয়ে বলেন, পারিবারিক কারণে তার আরও কিছু টাকার দরকার। একসঙ্গে ফেরত দিয়ে দিবেন। তারপর আমি আবার ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেই। টাকা পাঠানোর বিষয়টি আমি আমার পরিবারের সদস্যদের কাছে শেয়ার করি। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আমাদের কোনো আত্মীয় দুর্ঘটনায় পড়েননি। পরে বুঝতে পারলাম আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি।
ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ- পুলিশ কমিশনার জোনায়েদ আলম সরকার মানবজমিনকে বলেন, বাবা-ছেলে মিলে দু’জনেই চক্র গড়ে তুলে শত শত মানুষকে তারা ঠকিয়েছে। হুবহু নারীর কণ্ঠ নকল করে তারা বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতো। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল বিভিন্ন ভিভিআইপি সিম ব্যবহারকারীগণ। তাই তারা ভিভিআইপি সিরিজের সিম নম্বর সংগ্রহ করে ক্রমানুসারে ডিজিট পরিবর্তন করে কল দিত। কল দেয়ার আগে সেই নম্বর আইএমও অ্যাপ্সের মাধ্যমে নম্বর ব্যবহারকারী ব্যক্তির নাম জেনে নিত। কল দিয়ে নিজেকে দূর সম্পর্কের আত্মীয় পরিচয় দিত। নারী কণ্ঠে কথা বলে ওই ব্যক্তিদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতো। তিনি বলেন, এভাবে তারা বিগত ৭-৮ বছরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে। বহু মানুষ তাদের শিকার হয়েছেন। আমরা এখন পর্যন্ত অনেক ভুক্তভোগী পেয়েছি। যাদেরকে তারা ঠকিয়েছে।
ডায়ালসিলেট এম/
Address: Kaniz Plaza, Zindabazar, Sylhet
United Kingdom, London Mobile :+447438548379
dialsylhetnews@gmail.com
Design and developed by AshrafTech