প্রকাশিত: ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২১
ডায়ালসিলেট ডেস্ক::চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। পোশাক পরে দামি ব্র্যান্ডের। দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় গাড়িতে চড়ে। দিনে কমপক্ষে তিন হাজার টাকার হেরোইন লাগে। আর দুই প্যাকেট বেনসন সিগারেটের পাশাপাশি দিনে তিনটা করে ইয়াবাও লাগে। তার পেশার খবর শুনলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। কারণ সে একজন পেশাদার চোর। একযুগে এই চোর তিন হাজার বাসায় চুরি করেছে।
কামিয়েছে অন্তত দেড় কোটি টাকা। যার পুরো টাকাই হেরোইন, ইয়াবা আর সিগারেট খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হয়েছে কয়েকবার। বেশ কয়েকটি মামলার খড়গ ঝুলছে তার মাথায়। অভিজাত মাপের এই চোরের নাম মো. নজরুল ইসলাম সোহাগ। বেশ কয়েকটি চুরির মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ তার সন্ধান পেয়েছে।
ডিবি সূত্র জানিয়েছে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এলাকায় সোহাগের বাড়ি। ছোটবেলায় মা-বাবা, বোনের সঙ্গেই থাকতো। অভাব অনটনের সংসারে মা-বাবা ঝগড়াঝাটি করে আলাদা হয়ে যান। তারপর সোহাগ চলে আসে ঢাকার মতিঝিল এলাকায়। মতিঝিল, আরামবাগসহ আশেপাশের এলাকায় বেড়ে উঠে। তখন কয়েকজন টোকাই ছেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবছর টোকাই’র কাজ করেছে। একসময় তাদের মাধ্যমে ওই এলাকায় একজন চোরের সর্দারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে সেই সর্দারের পাল্লায় পড়ে বনে যায় চোর। একটি দুটি করে চুরি করতে শুরু করে। চুরি করা মালামাল তুলে দিতো সর্দারের হাতে। বিনিময়ে ৫০/১০০ টাকা পেতো। এভাবে ২০০৭ সালের শেষ দিক থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক সর্দারের অধীনে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আরেক সর্দার, ২০১৭ সালের শেষ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আরেকজন সর্দারের অধীনে চুরি করে। এভাবে সর্দারদের অধীনে চুরি করতে করতে সোহাগ বেশ দক্ষ চোর হয়ে উঠে। একসময় সিদ্ধান্ত নেয় আর চুরি করবে না। পরে সে নিজেই একটি চোরচক্র গড়ে তুলে। চক্রের সদস্য ছিল মোট দুজন।
ডিবি সূত্র জানিয়েছে, চুরি করতে করতে সোহাগের দক্ষতা অনেক বেশি হয়ে যায়। চুরির সুবাদে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করেছে। দিনে দিনে কৌশল রপ্ত করেছে। সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে রেকি করতো। রাতের বেলা একাই অপারেশনে যেত। মাঝেমধ্যে তার সহযোগী জুয়েলকে নিয়ে যেত। এ ছাড়া মানিক নামের আরেক পিকআপ চালককে সঙ্গে রাখতো। সোহাগ ও তার সহযোগীদের ব্যক্তিগত দুটি পিকআপ ছিল। এই পিকআপ সঙ্গে নিয়ে তারা চুরি করতে যেত।
সোহাগ ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে, পিকআপে ঘুরে ঘুরে সোহাগ, জুয়েল ও মানিক দেখতো কোন এলাকার কোন বাড়ি নীরব-সুনসান। কোন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো না। এ ছাড়া কোন কোন বাড়ির দারোয়ান রাতেরবেলা ঘুমিয়ে পড়ে। চুরি করে পালানোর রাস্তাও বের করে রাখতো। সোহাগ মই বা দড়ি ছাড়া ৮ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত উঠতে পারতো। অন্য চোরদের মতো সে গ্রিল বা তালা কাটার যন্ত্র নিয়ে যেত না। তার হাত দিয়ে জানালার গ্রিল বাঁকা করে বাসার ভেতরে প্রবেশ করতো। উত্তরা পশ্চিম থানা, বনানী থানা, ভাটারা থানা, তুরাগ থানা ও খিলক্ষেত থানা এলাকায় বেশ কয়েকটি চুরির মামলায় সোহাগের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসব থানার আওতাধীন এলাকায় সে বেশি চুরি করতো। এ ছাড়া সুযোগ বুঝে শহরের প্রায় সকল এলাকায়ই কমবেশি চুরি করেছে। বাসার ভেতর প্রবেশ করে তার টার্গেট থাকতো আইফোন, ল্যাপটপ ও স্বর্ণালঙ্কারের দিকে। এসব না পেলে যেকোনো ফোন, ল্যাপটপ বা যা পেতো তাই নিয়ে আসতো। আসার সময় যদি কিছু অপ্রয়োজনীয় মনে করতো তবে সেগুলো রাস্তায় ফেলে দিতো। ডিবি সোহাগের কাছ থেকে তোসিবা, এইচপি, মাইক্রোসফট, এসআর কোম্পানির ৬টি ল্যাপটপ, ৮টি মোবাইল ফোন যার মধ্যে ১টি আইফোন-১২ প্রো, ১টি আইফোন-১১ প্রো, ১টি আইফোন-৭ প্লাস, দুটি আইফোন-৭, ১টি স্যামসাং এ-টু কোর, ১টি স্যামসাং নোট ও ১টি রিডমি নোট, ১টি হাতঘড়ি ও দুটি ক্যামেরা উদ্ধার করেছে। চুরি করা মোবাইল গুলিস্তান এলাকায় বেশি বিক্রি করতো। এরমধ্যে গুলিস্তান পাতাল মার্কেট, স্টেডিয়াম মার্কেট, সুন্দরবন মার্কেটে নির্দিষ্ট কিছু দোকানে বিক্রি করতো। ওই দোকানিরা আবার কমদামে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে তা বিক্রি করতো। এ ছাড়া ল্যাপটপ বিক্রি করতো অন্য আরেকটি মার্কেটে। আর স্বর্ণালঙ্কার পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে বিক্রি করতো। বিক্রি করে যা আয় হতো তার ২০ শতাংশ দিতো মানিককে। আর জুয়েলকে কিছু দিতে হতো না। কারণ জুয়েল সোহাগের ডেমরার চনপাড়ার বাসায় থাকতো। তার বাড়ি ভোলা জেলায়। ছোটবেলা থেকে সেও ঢাকায় বেড়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন পিকআপের সহকারী হিসেবে কাজ করেছে। এখন কয়েক বছর ধরে চালক হয়েছে। সম্প্রতি সোহাগের সঙ্গে পরিচয়ের পর সে চুরির কাজে যোগ দিয়েছে। ডেমরার চনপাড়ার ওই বাসায় সোহাগের স্ত্রী-সন্তানও রয়েছে। চার বছর আগে ত্রিপুরার একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে সে।
ডিবি জানিয়েছে, সোহাগ একযুগে তিন হাজারের বেশি বাসায় চুরি করেছে। আগে সর্দারের অধীনে কাজ করতো তাই তার আয় হতো কম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে একাই চুরি করে। তাই এই সময়ে অন্তত দেড় কোটি টাকা আয় হয়েছে। এসব টাকার পুরোটাই নেশা করে উড়িয়ে দিয়েছে।
ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সোহাগ জানিয়েছে, ঢাকার মতিঝিল এলাকায় চারজন চোর সর্দার আছে। তাদের অধীনে কয়েকশ’ চোর কাজ করে। এসব সর্দাররা যুগ যুগ ধরে চুরি করছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছে। কমিশনভিত্তিতে বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের সংগ্রহ করে। পরে প্রশিক্ষণ দিয়ে চোর তৈরি করে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আরামবাগ এলাকার একটি স্থানে শত শত চোর আড্ডা দেয়। পাশাপাশি হেরোইন-ইয়াবা সেবন করে। সর্দাররা এসব চোরদের সমস্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। এসব চোরদের অনেকে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
২১শে সেপ্টেম্বর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ওয়াহিদুল হাসানের বাসায় গ্রিল ভেঙে চুরির ঘটনা ঘটে। চোর বাসা থেকে তিনটা মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ আরও কিছু জিনিস নিয়ে যায়। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় পরেরদিন মামলা করেন ভুক্তভোগী ওয়াহিদুল হাসান। ওই চুরির ঘটনায় ডিবি সোহাগের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। চুরি হওয়া মোবাইল ফোনগুলো উদ্ধার করেছে ডিবি। এর আগে গত ২৮শে জুলাই বনানী এলাকার ১৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর বাড়িতে ফ্ল্যাট ৩/বিতে চুরির ঘটনা ঘটে। এই ফ্ল্যাটটিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন এএএমএস শামসুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। তিনি একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ঘটনার দিন রাতে স্ত্রী-সন্তানসহ রাতের খাবার খাওয়ার পর তিনি অফিসের কাজে বসেন একটি রুমে। কাজ করার সময় হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে অন্য রুমে গিয়ে দেখেন কিছু জিনিসপত্র এলোমেলো। এ ছাড়া ১টি রুম থেকে দুটি ল্যাপটপ, ১টি মোবাইল ফোন ও অন্য রুম থেকে কিছু স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়ে গেছে। চোর তার বাসার জানালার গ্রিল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে। ঘটনার একদিন পরে বনানী থানায় গিয়ে শামসুজ্জামান একটি চুরির মামলা করেন। এ ঘটনায়ও সোহাগের সম্পৃক্ততা পেয়েছে ডিবি।
ডিবি গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম রেজাউল হক মানবজমিনকে বলেন, তিন হাজারের বেশি বাসায় চুরি করেছে সোহাগ। সারাদিন রেকি করতো আর রাতের বেলা অপারেশনে যেত। চুরি করতে যাওয়ার আগে হেরোইন-ইয়াবা সেবন করতো। দুজনকে বাইরে রেখে একা বাসায় ঢুকতো। হাত দিয়ে গ্রিল ভেঙে ফেলতো।
ডিবি গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, তাকে সাধারণ চোর বলা যাবে না। ছোটবেলা থেকেই চুরি করছে। দামি দামি জিনিসের প্রতি নজর থাকতো। চুরি করে আয়ের টাকায় নেশা করতো। তার সহযোগীকে আমাদের কব্জায় নিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, সোহাগ আমাদেরকে বেশকিছু চোরের সর্দারের নাম দিয়েছে। যাদের অধীনে শত শত চোর কাজ করে। প্রশিক্ষণ দিয়ে চুরির কাজে লাগানো হয়। আমরা এসব চোরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। এ ছাড়া চুরি করা মালামাল তারা যেসব স্থানে বিক্রি করে এসব স্থানের সন্ধান পেয়েছি।
ডায়ালসিলেট এম/
Address: Kaniz Plaza, Zindabazar, Sylhet
United Kingdom, London Mobile :+447438548379
dialsylhetnews@gmail.com
Design and developed by AshrafTech