স্টাফ রিপোর্টার॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১০২ তম জন্ম বার্ষিকীর উদযাপন অনুষ্ঠান পন্ড ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে লাঞ্চিত করার ঘটনায় ইউপি সদস্য জলি বেগম ও তার সহযোগী বহিরাগত অভিনাস দেবকে জামিন না মঞ্জুর করেছেন মৌলভীবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল আদালতের বিচারক। ২৭ মার্চ রোববার আসামীদের পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট গৌছ উদ্দিন আহমদ লিকসন জামিন চাইলে বিজ্ঞ আদালত না মঞ্জুর করেন।
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, ঘটনাটি ঘটে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গত ১৭ মার্চ জাতীর জনক জন্ম বার্ষিকীর উদযাপন অনুষ্ঠানে। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান আপ্পান আলী বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে আদালত মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। গ্রেপ্তারের পর ওই ইউনিয়ন সহ পূরো উপজেলায় স্বস্তি ফিরে আসে। শুরু হয় জলি বেগমের অনেক অজানা নানা কুকীর্তির বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা।


১৭ মার্চ সকাল ১০ টার দিকে জেলা পর্যায়ে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে তিনি নিজ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে আরেকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানের মধ্যে কেককাটা ও আলোচনা সভা ছিল। অনুষ্ঠান শুরু হলে এক বহিরাগত যুবক অভিনাস দেব হঠাৎ করে চেয়ারম্যান ও পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ শুরু করেন। এসময় ওই ইউনিয়নের মহিলা ইউপি সদস্য জলি বেগম বহিরাগত যুবককের সমর্থনে এক জোট হয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম বার্ষিকির মঞ্চস্থল লক্ষ্য করে সেন্ডেল নিক্ষেপ করেন মহিলা ইউপি সদস্য জলি বেগম।
ওই ঘটনার পর মহিলা ইউপি সদস্য জলি বেগম ও বহিরাগত যুবক অভিনাস দেব দ্রুত অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করতে চাইলে তাদের ইউপি কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। ইউপি সদস্য ও বহিরাগত যুবককে পুলিশের কাছে সোর্পদ করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন। কেক কাটা ও আলোচনা সভা পন্ড হলেও পরে উপস্থিত সকলকে নিয়ে দোয়া অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। খবর পেয়ে মৌলভীবাজার মডেল থানার এসআই সৈয়দ বশির আহমদ ইউপি সদস্য জলি বেগম ও অভিনাস দেবকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন।
ইউপি চেয়ারম্যান আপ্পান আলী জানান, ইউপি সদস্য জলি বেগম পরিষদের কার্যক্রম শুরু থেকেই নানা বির্তকিত আচরণ করছেন। সম্প্রতি তার মাকে পিঠিয়ে গুরুতর আহত করা, ইউপি সচিবের সাথে অশালীন আচরণ ও পরিষদের অন্যান্য সদস্যবৃন্দের সাথে খারাপ আচরণ করার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এবিষয়ে ওই ইউপি সদস্যকে একাধিক কারণ দর্শানো নোটিশও দেওয়া হয়েছে।
১৭ মার্চ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যলয়ে ঘটনার পূর্বে ইউপি সদস্য জলি বেগম তার মাকে পেঠানোর ঘটনার বর্ণনার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে তার গর্ভধারিণী মায়ের আর্তনাদ এমন ছিল “তুই আমার টেং এর সমাননি, তরে কেউ জিগায়নি” এমন কথা বলে আলমিরা থেকে টাকা পয়সা চুরির সন্ধেহ এনে মাকে মারধর করে গুরুতর আহত করেছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের উত্তর বাড়ন্তী গ্রামে ঘটনাটি ঘটে।
ওই ঘটনায় পর থেকে নিজ ইউনিয়নসহ পুরো উপজেলায় চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এমন নিন্দনীয় ঘটনায় জনপ্রতিনিধিদের মাঝে চলছে তোলপাড়। পঞ্চাশোর্ধ ওই মা তার মেয়ে ইউপি সদস্য মেয়ে জলি বেগম এর বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম আদালতে অভিযোগ দিতে এসে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন আর অঝর ধারায় কাঁদছেন। ওই মায়ের ক্রন্দনে লোকজন জড়ো হয়ে তার নির্যাতনের ঘটনা শোনেছেন। ওই হতভাগা মা একাধিক দিন ও কয়েক বার নির্যাতনে শরীরে নানা স্থানের ক্ষতচিহ্ন দেখাচ্ছেন আর জনপ্রতিনিধিসহ জড়ো হওয়া লোকদের কাছে নিজের মেয়ের শারিরিক ও মানুষিক নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা দিচ্ছেন। তার মুখে নিজের মেয়ের নির্যাতনের এমন বর্ণনার ওই ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
জানা যায় ওই ঘটনাটি ঘটেছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের উত্তর বাড়ন্তী গ্রামে জলি বেগমের বাড়িতে। মা ও মেয়ে ওই বাড়িতে পৃথক দুটি ঘরে বসবাস করেন। উত্তর বাড়ন্তী গ্রামের মৃত ফুল মিয়া ও সেলিনা বেগম এর একমাত্র মেয়ে জলি বেগম (৩০)। কামালপুর ইউনিয়নের ১,২, ও ৩ নং ওয়ার্ডের (সংরক্ষিত) নির্বাচিত মহিলা সদস্য জলি বেগম গেল একাধিক বার তার মাকে নানা গালিগালাজ করেন ও মারধর করে গুরুতরও আহত করেন। তার মা মৌলভীবাজার সদর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হওয়ার আগেই তাকে আবারও পিটিয়ে আহত করেন ও বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তার ওই নির্দেশনা না মানলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। কোনো উপায়ান্তু না পেয়ে ওই বৃদ্ধ মা গ্রাম আদালতের দ্বারস্ত হন। গ্রাম আদালতে গত ২১/০২/২০২২ ইংরেজি দায়ের করা অভিযোগে তিনি বলেন আমার মেয়ে বর্তমানে ১,২, ও ৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য। আমার মেয়ে আমাকে আমার পরিবারে প্রায়ই বিভিন্ন ভাবে শারিরিক নির্যাতন করে আসছে। ওইদিন দুপুর ১টার দিকে আমাকে বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলে। এক পর্যায়ে ইউপি সদস্য মেয়ে জলি বেগম এর সাথে কথা কাটাকাটি হলে সে আমাকে তার পায়ের জুতা,রড় ও কাঠ দিয়ে আঘাত করে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত ও জখম করে। প্রাণ বাচাঁতে আমি চিৎকার করলে কামালপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য মোঃ হুমায়ুন রশীদ, দক্ষিণ বাড়ন্তী গ্রামের জসিম মিয়া,আখলিছ মিয়া,ছয়দুল মিয়াসহ অনেকেই এসে আমাকে প্রাণে রক্ষা করেন।
ওই ঘটনার পর তিনি অন্যত্র চলে গেলে ইউপি সদস্য মেয়ে জলি আমাকে ফোনে প্রাণে মারার হুমকি দেয়। আমি নিরুপায় হয়ে গ্রাম আদালতে আশ্রয় ও সু-বিচার চান। গ্রাম আদালতে বিচার প্রার্থনার পর কয়েকদিন গোপন থাকলে পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জনপ্রতিনিধি মেয়ে মাকে মারধরের ঘটনায় পুরো উপজেলা জুড়ে বইছে নানা সমালোচনা। এ ঘটনায় তার জনপ্রতিনিধি হওয়ার বিষয় নিয়েও স্থানীয় জনগণের (ভোটারদের) মাঝে নানা বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। মা সেলিনা বেগম ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম আদালতে অভিযোগ করার আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন মেয়ে জলি বেগম।
স্থানীয়রা জানান, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদ্রসা থেকে ফাজিল ফাস করার পর অসখ্য বয়ফ্রেন্ডের সাথে জলি বেগম এর সখ্যতা গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে চলা ফেরায় বেপড়ুয়া হয়ে উঠেন জলি। বয়ফ্রেন্ডদের তালিকায় রয়েছেন শহরের ভিআইপি তালিকার বেশ কয়েক জন। বয়ফ্রেন্ডদের সাথে শুরু হয় একের পর এক প্রতারণা। তবে এসব প্রতারণার স্বীকার কেউ মান মর্যদা হারানোর ভয়ে মূখ খুলতে অনিহা প্রকাশ করছেন। তবে গ্রেপ্তারের পর অনেকেই জলি বেগমের সাথে পরিচয় ছিল সে বিষয়টিতেও অনিহা রয়েছে।
একাধিক স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান জলি বেগম একজন বহুরুপি নারী। হিজাব ও বোরকা পরে চলা ফেরা, আবার কখনও সেলোয়ার কামিজ ও শাড়ী পরে বিভিন্ন স্থানে বিচরণ। সে এক জন মামলাবাজ,দাঙ্গাবাজ,পরোধন লোভী ও প্রতারক। নানা পরিচয়ে তার রয়েছে একাধীক বির্তকিত কর্মকান্ড, পুরুষ বন্ধু ও নিজস্ব বলয়। সময়ে অসময়ে পৃথক পুরুষ বন্ধুর মটরবাইক ও প্রাইভেট কারে চড়ে এলাকায় অবাদ বিচরণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক) এর বিভিন্ন আইডিতে তার সাথে ঘনিষ্ট ও অন্তরঙ্গ মুহুর্তের অনেক পুরুষের ছবিও ও অশ্লীল চ্যাটিং রয়েছে। তার চালচলনে বিব্রত প্রতিবেশী ও গ্রামবাসীরা।
এলাকাবাসীরা জানান তার দাপঠের ভয়ে কেউই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস পায়না। লাইলী বেগম নামের এক নির্যাতিত নারী জলির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপার, ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দপ্তরে তার নানা প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার না পেয়ে সৃষ্ঠি কর্তার উপর ছেড়ে দেন।
অভিযোগ রয়েছে একই ইউনিয়নের বাড়ন্তী গ্রামের ৭০ উর্ধো মজনু মিয়া ও কদর মিয়াকে বিবাদী করে নারী ও শিশু নির্যাতনের ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলার পর আপোস মিমাংসার জন্য বড় অংকের অর্থ দাবী করেন জলি বেগম। এক পর্যায়ে মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন ৭০ উর্ধো ওই দু’জন। পরে ২০২১ সালের জুলাই মাসে মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়া মজনু মিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিষয়টি নিশ্চিত করেন মৃত্যুবরণকারীর ছোট ভাই ও সাবেক ইউপি সদস্য গৌছ মিয়া। এ ছাড়াও প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে আরও কয়েকটি মামলা দায়ের করেন বির্তকিত ওই নারী। সেইসব মামলায় আপোস মিমাংসার নামেও বড় অংকের টাকা চাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেলিনা বেগমের অভিযোগের বিষয়ে কামালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আপ্পান আলী জানান মুঠোফোনে জানান অভিযোগ পেয়ে ১৭/০২/২০২২ ইংরেজি স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৪ এর খ, ঘ মোতাবেক মহিলা ইউপি সদস্য জলি বেগমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে রয়েছে নিজের পদমর্যাদার দাম্বিকতা প্রকাশ করা, পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সাথে বেয়াদবী এবং অশালীন আচরণ করা, ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের অপ্রপ্রচার করা। এছাড়াও ইউপি সদস্য জলি বেগম মিষ্টার আলী নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে মৃত্যু সনদ নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করেন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *