তিস্তাসহ আন্তঃসীমান্তবর্তী নদীর পানি বণ্টনে দ্রুত চুক্তি চায় ঢাকা

প্রকাশিত: ৩:৩২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩

তিস্তাসহ আন্তঃসীমান্তবর্তী নদীর পানি বণ্টনে দ্রুত চুক্তি চায় ঢাকা

ডায়াল সিলেট ডেস্ক :: ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, অনিষ্পন্ন ইস্যু নিষ্পত্তির বিষয়ে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে তিস্তাসহ সব আন্তঃসীমান্তবর্তী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনে দেশটির নিবিড় সহযোগিতা প্রত্যাশা করে ঢাকা। তিনি বলেছেন, সীমান্ত হত্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এটিকে শূন্যে নামিয়ে আনতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে ভারত সরকার উদ্যোগ নেবে বলে আমরা প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি।
বুধবার এফওসি বৈঠকে এসব আলোচনা হয়। দুই বছর পর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এফওসিতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। অন্যদিকে ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে এসব তথ্য জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এফওসিতে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে ভারতের কাছে যেসব অনিষ্পন্ন ইস্যু রয়েছে, সেগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে তাদের সহায়তা কামনা করি। এ লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করি।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, তিস্তাসহ সব আন্তঃসীমান্তবর্তী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব পুনব্যর্ক্ত করি। বিষয়টি সমাধানের জন্য ভারতের নিবিড় সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছি। সেইসঙ্গে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সই করা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে ভারতকে বলেছি।

সীমান্ত হত্যা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন : তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা চলছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা করছি। তাদের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে যে সমস্যা আছে, সেটি বিদ্যমান রয়েছে। তারপরেও আমাদের যে আবেদন সেটার বিষয়ে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
গঙ্গা চুক্তি নবায়নের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ওরাও হয়ত করছে। আগামীতে দুই পক্ষ হয়তো প্রাক-চুক্তি পর্যালোচনার জন্য বসবে।
সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সীমান্ত বাংলাদেশি নাগরিক যাতে মৃত্যুবরণ না করে সেটির বিষয়ে তারা বলেছে যে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়। তবে সীমান্তের কিছু কিছু এলাকাতে যে ধরনের বেআইনি কার্যকলাপ আছে সেগুলোর বিষয়ে বিএসএফ ও বিজিবি আরও সজাগ থাকে তাহলে এটি কমিয়ে আনতে পারি। সীমান্ত হত্যা আমরা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসার বিষয়ে বলেছি এবং তারাও বলেছে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আন্তঃসীমান্ত অপরাধসহ সীমান্তে অপরাধমূলক কার্যক্রমে আমাদের চলমান প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করার বিষয়ে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে।

আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে আলোচনা হয়নি : আদানি পাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা চলছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে হওয়া বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চান সাংবাদিকরা।
জবাবে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আদানি গ্রুপের বিষয়ে আলাদাভাবে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য যে সহযোগিতা যেমন পাইপলাইন বা ট্রান্সমিশন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা একটি অনুরোধ রয়েছে তাদের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে বিদ্যুৎ নেবে। এ বিষয়ে আমরা কিছু কাজ করেছি। সেগুলো আমি তাকে অবহিত করেছি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারত আশ্বস্ত করেছে, নেপাল ও ভুটান থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ আনার যে বিষয়টি রয়েছে, সেটির বিষয়ে আমরা নির্দিষ্ট প্রকল্প নিয়ে এগোতে চাই। তারা এ বিষয়ে সাহায্য করবেন বলেছেন। নেপালের পানি মন্ত্রী দিল্লিতে যাচ্ছেন। সেখানে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের সঞ্চালন লাইনের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। বিদ্যুৎ সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসলেও সেটিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু কাজ করতে হবে। সঞ্চালন লাইনের সমস্যার কথা আমরা শুনলাম। এখন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাব। এটি যদি দ্রুত করা যায় তবে বিদ্যুৎ যখন আমাদের দ্বারপ্রান্তে আসবে তখন এটি গ্রহণ করা যাবে।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির বিষয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ভারত হতে বর্তমানে প্রায় ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি। ভারত হয়ে আমাদের বিদ্যুৎ আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা আশা করছি।
‘চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহে আমি গুরুত্ব আরোপ করেছি।’- যোগ করেন পররাষ্ট্র সচিব।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র পাচার ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতকে অবস্থান ব্যাখ্যা ঢাকার : পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র পাচার ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে জানান মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, আমরা কোনো ধরনের উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেই না। আমরা খবর পেয়েছি কিছু তরুণ তাদের পরিবার থেকে চলে গেছে। পরবর্তীতে তারা যখন পুলিশের কাছে আসল, তখন খবর পাওয়া গেল যে বান্দরবনে অনেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তখন কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদেরকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চলছে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমরা ব্যাখ্যা করেছি যে, কোন প্রেক্ষাপটে এই অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়েছে এবং এর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হচ্ছে সেখানকার বম গোষ্ঠীর কিছু লোক ভয় পেয়ে মিজোরামের দিকে চলে গেছে। সংখ্যাটি সেরকম বেশি না। তবে এটি তাদের জন্য রাজনৈতিক সমস্যার তৈরি হয়েছে। আমরা বলেছি যে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে আমরা আগ্রহী। যদি সাহায্য প্রয়োজন হয় সেটি আমরা করব। তিনি বলেন, তারা আমাদের ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযানের ফলে বেসামরিক লোকেরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে আমরা আরও যত্নবান থাকব।

জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী : চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেপ্টেম্বরে জি ২০ এর মূল সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি।

বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, নির্বাচন ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ : ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধিতে কমপ্রিহিনসিভ পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-সেপা চুক্তি করার বিষয়ে দ্রুত আলোচনায় বসার বিষয়টি এসেছে এফওসিতে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তর বাণিজ্য অংশীদার। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যে সমস্ত ট্র্যারিফ বা বাধা আছে সেগুলো দূর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। আমরা ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছি।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সেপা সম্পাদনের জন্য আলোচনা দ্রুত সময়ের মধ্যে করার বিষয়ে আলোচনা করেছি। আর ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা ও কার্যক্রম বেগবান করতেও একমত হয়েছি। পর্যটকদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজিকরণে ভারতের আরও সহযোগিতা চেয়েছি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়নি বলে জানান তিনি। পাশাপাশি এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানেও ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলেও জানান মাসুদ বিন মোমেন।

0Shares