যে কারণে প্রার্থী হলেন না আরিফ

প্রকাশিত: ১:১৪ পূর্বাহ্ণ, মে ২১, ২০২৩

যে কারণে প্রার্থী হলেন না আরিফ

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন

 

ডায়াল সিলেট ডেস্ক :: দল অথবা নির্বাচন—এমন একটি কঠিন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সিটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি বিশেষত দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছিলেন অনড়। দলের কেউ যাতে প্রার্থী না হয়, সেজন্য বিএনপি থেকে নানামুখী তৎপরতা চালানো হচ্ছিল। তাই ভোটে অংশ নিতে হলে দল ছাড়তে হতো বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির এই সদস্যকে।

 

অবশেষে দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আসন্ন সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। শনিবার বিকেলে সিলেট নগরের রেজিস্ট্রারি মাঠে এক নাগরিক সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন।

 

দলের চাপ, ইভিএমে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা, প্রশাসনের ভূমিকায় সন্দেহ আর নিজের কিছু হিসাব-নিকাশ না মেলায় আরিফুল হক নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

 

যদিও এর আগে আরিফুলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নির্বাচন নিয়ে তার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি গত ১ মে সিলেটে একটি সমাবেশে তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে (বিএনপি) সিটি নির্বাচন অংশ নিচ্ছে না। তবে সিলেটের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সিলেটের প্রেক্ষাপটে আমরা নির্বাচনে যাব।’

 

তবে ১ মে’র পর প্রশাসনের ভূমিকা আর দলের চাপের কারণে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে শনিবার নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দেন আরিফ।

 

আরিফুল-ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, দলের আপত্তি সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তবে তার আগে চারটি হিসেব মেলান তিনি। প্রথমত, দলের বিরোধিতা করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে বিএনপির রাজনীতিতে আবার ফিরতে পারবেন কি না। দ্বিতীয়ত, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে কি না। তৃতীয়ত, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় আরিফুল বলয়ের দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে অংশ নিতে পারবেন না। নির্বাচনে তারা এজেন্টের দায়িত্বও পালন করতে পারবেন না। এতে ৪২টি ওয়ার্ডের মোট ১৯০টি কেন্দ্রে বিশ্বস্ত এজেন্ট পাওয়া যাবে কি না। এবং চতুর্থত, ইভিএমে সুষ্ঠু ভোট হবে কি না।

 

এসব প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব না মেলায় আরিফুল হক প্রার্থিতার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন বলে জানিয়ে তারা বলেন, ১ মে আরিফুল হক প্রার্থিতার ইঙ্গিত দেয়ার পর থেকেই সিলেটে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। মেয়রের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এতে সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া বিএনপির কোনো কর্মীও যাতে নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করেন, এ ব্যাপারে দলটির পক্ষ থেকে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। ফলে প্রচার ও নির্বাচনী কাজে বিশ্বস্ত কর্মী পাওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

 

শনিবারের সমাবেশেও এমনটি উল্লেখ করেছেন আরিফুল। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেইনি। অথচ আমার নেতাকর্মীদের ঘর থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসছে। মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। রিমান্ডে নিচ্ছে। একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া ভোটের আগে আগে পুলিশ প্রশাসনে রদবদল করা হচ্ছে। এসবই প্রমাণ করে সুষ্ঠু ভোট হবে না।’

 

আসন্ন নির্বাচনকে প্রহসনের উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ‘এই মূহূর্তে সিলেট তথা সারা দেশেই নির্বাচনী কোনো পরিবেশ নেই। আপত্তি সত্ত্বেও সিলেটে ইভিএমে ভোটগ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে। অথচ সিলেটের মানুষ ইভিএমের সাথে একেবারে অপরিচিত। এখানে ইভিএম নিয়ে আসাই ভোট ডাকাতির ইঙ্গিত। বর্তমান নির্বাচনও কমিশন সুষ্ঠু ভোট চায় না। তারা ডিজিটাল ভোট ডাকাতি চায়।’

 

আরিফুল বলেন, ‘নির্বাচনে কারচুপির নীলনকশার অংশ হিসেবে পুলিশ প্রশাসনে রদবদল শুরু হয়েছে। একটি প্রহসনের নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। এরকম অবস্থায় আমি নির্বাচনে যেতে পারি না। আমি বিএনপির সিদ্ধান্তের সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমি প্রহসনের নির্বাচনে প্রার্থী হব না।’

 

জানা যায়, মেয়র হওয়ার পর সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে আরিফুলকে নিয়ে বিএনপির মধ্যেই সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছিল। তাই আরিফুল হক ব্রাক্ষণবাড়িয়ার উকিল আব্দুস সাত্তারের মতো হতে পারেন বলেও দলে শঙ্কা ছিল।

 

বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে গত জানুয়ারিতে ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন উকিল আব্দুস সাত্তার। ওই নির্বাচন ‘উকিল আব্দুস সাত্তার মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পায় রাজনীতিতে। সিলেট সিটিতে বিএনপি নেতা আরিফুল হকও সরকারের সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী হতে পারেন বলে গুঞ্জন ছিল। বিশেষত সিলেটের দুই সরকারদলীয় নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবদুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে বিএনপির মধ্যেই আরিফকে নিয়ে কানাঘুষা ছিল।

 

তবে এমন গুঞ্জন উল্লেখ করে শনিবার মেয়র বলেন, ‘যারা মনে মনে আমাকে উকিল আব্দুল সাত্তার বানানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা আজ হতাশ হয়েছেন। আরিফুল হক কখনও উকিল আব্দুস সাত্তার হবে না। আমি আপনাদের আরিফ, আমি বিএনপির আরিফ। তাই আমার নেত্রী খালেদা জিয়া, নেতা তারেক রহমান ও আমার মায়ের নির্দেশে আমি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হব না। তাদের আদেশই আমার শিরোধার্য।’

 

তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সঙ্গেও আরিফুকের দূরত্ব রয়েছে বলেও জানা যায়। ফলে তফসিল ঘোষণার পর লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করে প্রার্থী না হওয়ার বদলে দলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদের আবদার করলেও তাকে কোনো আশ্বাস দেননি তারেক। উল্টো আরিফুলকে ঠেকাতে দলের নানা পর্যায় থেকে চাপ দেওয়া হয়। সর্বশেষ বিএনপিদলীয় একজন কাউন্সিলরের সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা আরিফের উপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। শুক্রবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সিলেটে এসে আরিফুলের উপস্থিতিতে জনসভায় বলেন, দলের নির্দেশনা অমান্য করে কেউ প্রার্থী হলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।

 

এমনকি শনিবার আরিফুলের নাগরিক সভায়ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জীবন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলনসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার উপস্থিতি এই চাপের অংশ বলেও মনে করেন দলীয় নেতারা।

 

সমাবেশের পর আরিফুল হকের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘বিএনপি একটি বিশাল দল। কিন্তু এর বাইরেও আরিফুল হকের ব্যক্তি ইমেজও বিশাল। এই নগরের সব দলের মানুষ তাকে পছন্দ করে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আবারও তিনি বিশাল ব্যবধানে জয়ী হবেন। তবু দল ও জনগণের কথা ভেবে তিনি আজ যে উদারতা দেখিয়েছেন, তা অবিস্মরণীয়। বিএনপি এবং জনগণ তা সবসময় কৃতজ্ঞ চিত্তে মনে রাখবে। এবং আগামীতও তিনি বিএনপির কাণ্ডারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।’

 

আর আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, দল থেকে তার উপর কোনো চাপ নেই।

 

আগামী ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হবেন কি না, তা নিয়ে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। অবশেষে তিনি নিজেই প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সব জল্পনার অবসান ঘটালেন।

 

শনিবার বিকালের সমাবেশে প্রার্থী না হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে আরিফুল বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনেও নানা ভয়, প্রতিবন্ধকতা ও কারচুপি উপেক্ষা করে এই নগরবাসী আমাকে বিজয়ী করে এনেছেন। তারা ফলাফল ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র ছাড়েননি। কিন্তু এবার প্রেক্ষাট ভিন্ন। এবার আপনারে চাইলেও আমাকে বিজয়ী করতে পারবেন না। কারণ এবারের ভোট হবে ইভিএমে। এবার আপনারা একজায়গায় ভোট দেবেন, কিন্তু তা অন্য বাক্সে জমা হবে।’

 

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ