শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিকদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের হার বেশি

প্রকাশিত: ৮:০১ অপরাহ্ণ, মে ২৭, ২০২৩

শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিকদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের হার বেশি

ডায়াল সিলেট ডেস্ক : বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিকদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। চা শ্রমিকদের অধিকাংশ পরিবারেই কেউ না কেউ আক্রান্ত। প্রতি বছরই কুষ্ঠ রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুষ্ঠ রোগের রেড জোনে রয়েছে শ্রীমঙ্গল উপজেলা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগ কন্ট্রোল অফিস সুত্রে জানা যায়, এ বছর শ্রীমঙ্গল উপজেলায় মোট ৩৮ জনের কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। কুষ্ঠ রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি বিভিন্ন চা বাগানের চা শ্রমিক। আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ২২ জন এবং পুরুষের সংখ্য ১৬ জন। এর মধ্য শিশু ১ জন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ৩৭ জন।

উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের জাগছড়া চা-বাগানে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত তুফানী নায়েক বলেন, ২০০২ সালে তার দুই হাত ও দুই পায়ের কিছু অংশে চামড়া ঝলসানোর মতো বাদামি দাগ ফুটে ওঠে। সেই অংশটা প্রায় অবশ হয়ে যায় দিনে দিনে। তাকে নেওয়া হয় শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তুফানী প্রথম জানতে পারেন তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। এর আগে এ সম্পর্কে তার বা পরিবারের কোনো ধারণা ছিল না। ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই শুরু হয় তার চিকিৎসা। তবে তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চিকিৎসায় তেমন সুফল মেলেনি। বর্তমানে তুফানীর দুই হাতের আঙুলগুলো শক্ত ও বাঁকা হয়ে গেছে। পায়ের নিচের অংশ দিয়ে রক্তপাত হয়। চলাফেরায় অসম্ভব কষ্ট করতে হয় তাকে। লোহার মতো শক্ত হাতের আঙুল দিয়ে কোনো কিছু ধরতে পারেন না। খাওয়াদাওয়াসহ সবকিছুতে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। যন্ত্রণায় ঘুম হয় না।

শনিবার (২৭ মে) দুপুরে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর স্বাস্থ্য পরিদর্শক (ইনচার্জ) মোঃ মাহবুবর রহমান জানান, বর্তমানে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগ বিভাগের অধিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শ্রীমঙ্গল শহরের কলেজ রোডে পুরুষ ১ জন, পূর্বাশা আবাসিক এলাকায় পুরুষ ১ জন, শহরতলীর মুসলিমবাগ এলাকায় ১ জন নারী, ভূনবী ইউনিয়নের আলিশারকুল এলাকায় ১ জন পুরুষ, ১ জন নারী, সাতগাঁও চা বাগানে ২ জন নারী, কালাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর এলাকায় ১ জন পুরুষ, ফুলছড়ি চা বাগানে ১ জন পুরুষ, মাজদিহি চা বাগানে ১ জন পুরুষ, ২ জন মহিলা, শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের সন্ধানী আবাসিক এলাকায় ১ জন পুরুষ, রাজঘাটন ইউনিয়নের রাজঘাট চা বাগানে ২জন নারী, বর্মা ছড়া চা বাগানে ২ জন পুরুষ, ২ জন নারী, ভুড়ভুরিয়া চা বাগানে ৩ জন নারী, ১ জন পুরুষ, জেরিন চা বাগানে ২ জন নারী, ২ জন পুরুষ, ভাড়াউড়া চা বাগানে ২ জন পুরুষ, খেজুরি ছড়া চা বাগানে ১ জন নারী, ১ জন পুরুষ, মাজদিহি চা বাগানে ২ জন নারী, ১ জন পুরুষ, খাইছড়া চা বাগানে ১ জন পুরুষ, টিপড়া ছড়া চা বাগানে ১ জন পুরুষ, উদনা ছড়া চা বাগানে ১ জন নারী, ১ জন পুরুষ, ভুড়ভুড়িয়া চা বাগানে ২ জন নারী এবং ১ জন পুরুষ।

দুপুরে কথা হয় শহরতলীর মুসলিমবাগ এলাকার বাসিন্দা, কুষ্ঠ রোগী পারুল বেগমের সাথে। তিনি বলেন, আমি গত ৩ মাস ধরে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগ বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। ওষুধ সেবনের পর থেকে আমার হাতের দাগ অনেকটা কমার দিকে।

১৫ মাস যাবৎ কুুষ্ঠ রোগের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম। মুঠোফেনে তার সাথে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কোমরের নিচের মাংস পেশিতে আমার এ রোগ। ওষুধ খেয়ে ৬ মাস পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরো সুস্থ হতে পারিনি। ইনফেকশন হয়ে গেছে। আমি এ রোগ নিয়ে চিন্তিত। তবে হাসপাতাল থেকে ডাক্তাররা আমাকে ফ্রি ওষুধ চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। এখন ইনফেকশন হয়ে যাওয়ায় যন্ত্রণা ভোগ করছি।

জানতে চাইলে চা শ্রমিক নেতা সীতারাম বিন বলেন, এর মূল কারণ চা বাগানের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর এবং অসচেতন।  তারা কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে সচেতন নয়। উপরন্তু, তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে হয়। যার কারণে চা বাগানে এ রোগের প্রকোপ বেশি।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগ কন্ট্রল এসিসট্যান্ট (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, কুষ্ঠ রোগী হিসেবে শনাক্ত হওয়ার ভয়ে আক্রান্ত অনেকে চিকিৎসকের কাছে যান না। কেউ কেউ কবিরাজসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নেন। এসব কারণে সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে সময় লাগে। ততদিনে রোগ অনেক দূর গড়ায়। এতে অনেকেই প্রতিবন্ধিতার শিকার হন। এ বিষয়ে মানুষের মাঝে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন প্রতি বছর কুষ্ঠু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সুস্থ হয়েও ওঠেছেন অনেকেই। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় এবছর ৭ জন সুুস্থ হয়েছেন এবং আক্রান্তরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। নিয়মিত ওষুধ খেলে তারাও সুস্থ হয়ে ওঠবেন।

চা-বাগানে এ রোগটি কেন বেশি হয় জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক ব্যাধি। যা মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি দিয়ে হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ায় অনুভূতিহীন দাগ দেখা দেয়। যা হালকা লালচে এবং তামাটে বর্ণের হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি চিহ্নিত করে চিকিৎসা না নিলে অঙ্গহানি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, কুষ্ঠ আক্রান্তের হার চা বাগানের শ্রমিকদের মাঝে বেশি। চা-বাগানের শ্রমিকদের অনেক ক্ষেত্রে ভিড়ের মধ্যে কাজ করতে হয়। এসব বাগানের শ্রমিকরা অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেন। তাদের উপযুক্ত খাবার, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য সুবিধার অভাব থাকে। তাই তারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন। এ কারণে এই রোগের প্রকোপ বেশি। চা বাগানে এখন কুষ্ঠ শনাক্তে কর্মসূচি জোরদার করা হয়েছে। এ জন্য রোগী শনাক্ত বেড়েছে। সরকার তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপত্রসহ সবধরণের চিকিৎসা সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া যারা কুষ্ঠ রোগে সম্পূর্ণ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, তাদের প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ