মনজু বিজয় চৌধুরী॥ বাঁশের খুঁটির ওপর টিনের দোচালা ছাউনি। চারপাশই খোলা। এ-রকম সারি সারি দোকানপাট শ্রীমঙ্গলে মিরতিংগা বাজারে। এ বাজারের প্রতিষ্ঠাকাল কারও জানা নেই। তবে এর বয়স কমপক্ষে দেড়শ বছর হবেই। বলছিলেন রহিমপুর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়াডের মেম্বার ধান বাউরি। বাপ-দাদার কাল থেকেই এ বাজারের কথা শুনে আসছেন তারা। ধান বাউরিই জানালেন, একসময় বাজারটি ছিল টিলার ওপর। জমজমাট হয়ে ওঠায় আর ক্রেতা-বিক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় বছর পঞ্চাশেক আগে এটিকে মিরতিংগায় নিয়ে আসা হয়। মিরতিংগা বাজারটি আছে বলেই এই বাগান ও এর আশপাশের গ্রামাঞ্চলের বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের বাইরের কোনো হাটবাজারে যেতে হয় না। মাছ, মাংস, শুঁটকি, নানা জাতের সবজি, জুতা, কসমেটিক্স, ভ্রাম্যমাণ ফার্মেসি, কাপড়, ফল, প্লাস্টিক সামগ্রী, ফার্নিচার, পান-সুপারি, চা, গাছের চারা, গরু-ছাগল, মোরগ, চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সব সামগ্রীই মেলে এখানে।
উপজেলার মিরতিংগা চা-বাগানের ছোট এ বাজারে রয়েছে শতাধিক ছোট দোকান। মাজদিহি-মিরতিংগা পাকা সড়কের উত্তর পাশে এর অবস্থান। দক্ষিণ পাশের সবুজাভ চা-বাগান এ বাজারের আকর্ষণ ও গুরুত্বকে বাড়িয়ে তুলেছে। চা-বাগানের অধিবাসীরা ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষজন প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার এ বাজারে আসেন পণ্য নিয়ে, না হয় জিনিসপত্র বিক্রি করতে। এ দুই দিন দুপুর থেকে গভীর রাত অবধি সরগরম থাকে এ বাজার।
মিরতিংগা চা-বাগানের ঐতিহ্যবাহী এ বাজার ঘুরে দেখা গেল, পুরো বাজারে সারি সারি দোকানপাট খুলে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু চা-বাগানের শ্রমিক ও আশপাশের গ্রামের মানুষ নন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী কিনতে এখানে ভিড় করেছেন দূরদূরান্তের মানুষজনও। স্থানীয় সাইফুল ইসলাম জানালেন, বাজারটি দেখতে এসে স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত রাসায়নিক কীটনাশকমুক্ত সবজি কিনেছেন তিনি।
স্থানীয় আব্দুল বাছিত খান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি মিরতিংগা চা-বাগান বাজারের ওপর নিভরশীল আশপাশের ১২টি গ্রামের মানুষ। এক বাজারেই রয়েছে জীবন ও জীবিকার সব অনুষঙ্গ বা উপকরণ। ২০-২৫ বছর ধরে একই রকম দেখে আসছি ঐতিহ্যবাহী এ বাজারটিকে।
মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী কিশোরী প্রসাদ বলেন, ‘আমি ৫৭ বছর ধরে মিরতিংগা বাজারে জিলাপি, নিমকি, মিষ্টিসহ নানা সামগ্রীর ব্যবসা করছি। আমার বাবাও এ বাজারে একই ব্যবসা করতেন। বাবার কাছে শুনেছি আমার দাদা এ বাজারে প্রথম এ ব্যবসা শুরু করেন।
বাসিন্দা জয়ন্ত দেবনাথ জানান, মিরতিংগা বাজারে সস্তায় ছাগল পাওয়া যায়। গত ছয় মাস আগে তিনি এখান থেকে একটি ছাগল কিনেছেন। আবারও এসেছেন কিনতে।
সবজি ব্যবসায়ী মো. ছামাদ মিয়া বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি এ বাজারে সবজির ব্যবসা করছেন। এ বাজারে তার ব্যবসার বয়স ৪৬ বছর। এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত সবজি জমি থেকে কিনে তিনি এ বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি করেন। এ ব্যবসা করেই তিনি তার পরিবার চালাচ্ছেন।
মেম্বার ধনা বাউরি বলেন, ‘বাজারটি যুগ যুগ ধরে একই অবস্থায় রয়েছে, কোনো সংস্কার নেই।’ বাজারটির সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর আবেদন জানান তিনি।
মিরতিংগা চা-বাগান সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি নিশী গঞ্জু বলেন, ‘আমি মিরতিংগা বাজারে প্রায় ১৫ বছর ধরে স্টেশনারি ব্যবসা করছি। আমার বাবাও তাই করেছেন।’
