‘ভাইও মোর চান্দের মতো মাইয়াডা…।’ তারপর আর কথা বলতে পারেন না ইউনুস মিয়া (৫২)। ডান হাতে ধরে থাকা মুঠোফোন কান থেকে ধীরে ধীরে বুকে নেমে আসে। দুই হাতে বুক চেপে ধরে থানার বারান্দায় হাঁটু গেড়ে বসেন ইউনুস। ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিজে নিজেই বিলাপের স্বরে কিছু বলতে থাকেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানার বাইরের সড়কে তখন শীতলক্ষ্যা পার হয়ে বন্দরে ফেরা মানুষের হাঁকডাক। শহুরে যান্ত্রিক শব্দে ইউনুসের বিলাপের স্বর মিলিয়ে যায়। অস্পষ্ট স্বরে বলা ইউনুসের কথাগুলো কানে এলেও বোঝা যায় না।
গতকাল রোববার রাত ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানার বারান্দায় দেখা হয় পেশায় কাঠমিস্ত্রি ইউনুসের সঙ্গে। বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে তিনি মুন্সিগঞ্জ থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নারায়ণগঞ্জে এসেছেন স্ত্রী ও মেয়ের মরদেহ নিতে। শীতলক্ষ্যা নদীতে রূপসী-৯ কার্গোর ধাক্কায় গতকাল দুপুরে ডুবে যাওয়া এমএল আফসারউদ্দিনের যাত্রী ছিলেন তাঁর স্ত্রী সালমা বেগম (৩৮) ও সাত বছরের মেয়ে ফাতেমা।
থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে স্বজনদের সেই মৃত্যুর খবরই জানাচ্ছিলেন ইউনুস। সেখানেই জানা যায়, ভুল করে মৃত্যুকূপে আসা সালমা বেগম ও তাঁর মেয়ে ফাতেমার কথা।
নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি আজ সোমবার ভোরে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় উদ্ধার করে নদীর পাড়ে রাখে
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে ইউনুসদের বাড়ি। ছয় সন্তান নিয়ে থাকেন মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর এলাকায়। ইউনুস-সালমা দম্পতির সন্তানদের মধ্যে সবার ছোট ফাতেমা। পড়াশোনার বয়স হয়েছে, মাদ্রাসায় ভর্তি করতে মেয়ের জন্মনিবন্ধন প্রয়োজন। জন্মনিবন্ধন করতে গতকাল দুপুরে পটুয়াখালীর উদ্দেশে ঘর ছাড়েন মা-মেয়ে।
মুন্সিগঞ্জ থেকে পটুয়াখালী যেতে হলে ঢাকার সদরঘাটের লঞ্চ ধরতে হবে সালমাদের। কিন্তু ভুল করে তাঁরা সদরঘাটের লঞ্চের বদলে চড়ে বসেন নারায়ণগঞ্জের লঞ্চে। নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাটে এসে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে পরের লঞ্চেই আবার মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দুপুরে পথ ভুল করার কথা মুঠোফোনে বড় মেয়েকে জানান সালমা। ইউনুসকে জানাতে নিষেধ করেন। কার্গোর ধাক্কায় সালমাদের লঞ্চটি ডুবে গেলে শীতলক্ষ্যায় ডুবে মৃত্যু হয় মা ও মেয়ের। গতকাল সন্ধ্যায় দুজনের লাশ উদ্ধার করেন ডুবুরিরা। সালমার সঙ্গে থাকা মুঠোফোনের সূত্রে খবর যায় ইউনুসের কাছে।
লাশ শনাক্তের পর থেকে কান্না থামছে না ইউনুসের। ভুল করে ভুল পথে যাত্রা করায় প্রিয়জনের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। কাঁদতে কাঁদতে গত শনিবার রাতের কথা মনে করেন। বলেন, ‘রাইতে বাসায় গেলাম। মাইয়াডা খায় না। ওর মা চান দেখাইতে দেখাইতে ওরে ভাত খাওয়াইল। হেই চান্দের মতো মাইয়া আমার কথা কয় না।’
থানার কাজ সেরে লাশ নিয়ে বের হতে হতে রাত দেড়টা। শীতলক্ষ্যা ঘাটের ব্যস্ততা কমে আসে। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে ওঠে। থানা থেকে পটুয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন ইউনুস মিয়ারা। সঙ্গে এত দিনের সঙ্গী স্ত্রী আর ‘চান্দের মতো’ মেয়ের লাশ।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

 

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *