ডায়ালসিলেট ডেস্ক::ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পিছিয়ে নেই খাদ্যবহির্ভূত খাতও। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পর গত বছরের মার্চ থেকে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েই চলেছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে আরও বেড়ে গেছে রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, স্যানিটারি উপকরণ, পাথর, গ্লাস ও টাইলসের দাম। ফলে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ সম্পন্ন ও হস্তান্তর প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কমে গেছে নতুন বিক্রিও। আকাশচুম্বী নির্মাণসামগ্রীর দামের ফলে দেশের আবাসন খাত এখন অনেকটাই স্থবির। দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এদিকে বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা করার এক সপ্তাহের মাথায় রডের দাম টনপ্রতি ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা করে বেড়ে গেছে। বাড়তে বাড়তে কোম্পানির মানভেদে (৬০ গ্রেডের ওপরে) খুচরায় রডের টন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। রড প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর মতে, রডের বড় অংশের কাঁচামাল আসতো ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমুদ্র রুটে বেশ খারাপ প্রভাব পড়েছে। ফলে দেশের বাজারে রডের দাম বেড়েছে। রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, সব কোম্পানির সিমেন্টের দাম গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা বেড়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্যানুসারে, গত এক বছরে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। ৬৪ হাজার টাকা টনের রড এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৮ থেকে ৯০ হাজার টাকায়। ভালো মানের প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ছাড়িয়েছে ৪৬০ টাকা। ৮ টাকার প্রতি বর্গফুট বালুর দাম উঠেছে ৩০ টাকা। ১৭০ টাকা ছিল এক সিএফটি পাথর, এখন ২২২ টাকা। ইট ছিল ১২-১৩ হাজার এখন ১৬ হাজার টাকা এক গাড়ি। সংগঠনটি জানায়, ২০২০ সালে প্রায় ১ লাখ অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। এসব অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট কেনার জন্য বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত বছর বিক্রি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট। এসব অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট কেনার জন্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ২০২০ সালে বিক্রয় হওয়া ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের ৫০ শতাংশের বেশি এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর সম্ভব হয়নি বলে জানায় রিহ্যাব। আর ২০২১ সালে বিক্রি হওয়া ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের ৭০ শতাংশের বেশি এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করা যায়নি। রাজধানীর একটি শীর্ষ আবাসন প্রতিষ্ঠান জানায়, ১লা মার্চ থেকেই তাদের বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুটে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আবাসন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রাইভেট) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, গৃহ নির্মাণ সামগ্রীর বাজারদর এখন পর্যন্ত ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ ছাড়া আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট ব্যয়ও বাড়ছে। শেলটেক ইতিমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে চুক্তি হয়েছে এমন ফ্ল্যাটগুলো যথাসময়ে হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আবাসন খাতের প্রায় ৩৫ লাখ নির্মাণ শ্রমিকের মধ্যে বেশিরভাগ কাজ হারাবে। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরে নতুন ছোট ছোট আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে ফ্ল্যাটের মান ও এলাকাভেদে এই দাম কম-বেশি বাড়ানো হচ্ছে। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যাতে গ্রাহকরা মানানসই করে নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে পারে, সেই বিষয় মাথায় রেখে যৌক্তিক হারে দাম বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ গ্রাহক যদি ফ্ল্যাট না কেনে, আমাদের ব্যবসা চলবে না। রাজধানীর আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছর ও এর আগের বছর প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার সাধারণ ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে বলে জানান তিনি। কিন্তু মার্চেই বিক্রিও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কাওরান বাজারের খুচরায় রড বিক্রেতা ভাই-ভাই স্টিল-এর মালিক কাদের বলেন, গত কয়েকদিনের মধ্যে দুই দফা রডের দাম বেড়েছে। দাম বেড়ে পাইকারিতে বিএসআরএমের রড ৮৯, কেএসআরএমের ৮৭ হাজার ৫০০, জিপিএইচ ৮৭ হাজার ৫০০, বায়েজিদ স্টিল ৮৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরায় ৯০ থেকে ৯৩ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবি’র বাজার দর হিসেবে, এম এস রড (৬০ গ্রেড) প্রতি টন ৮৩ থেকে ৮৯ হাজার ৫০০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে দর বেড়েছে ১০.৯৩ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২৩.৬৬ শতাংশ। এদিকে এম এস রড (৪০ গ্রেড) প্রতি টন ৭৪ থেকে ৭৮ হাজার ৫০০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে দর বেড়েছে ৫.৫৪ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১৫.০৯ শতাংশ। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম বলেন, বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম ৬৭০ থেকে ৭২০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। দেশের লোকাল মার্কেট থেকে স্ক্র্যাপ কিনতে হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। শিপইয়ার্ডের স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। এসব স্ক্র্যাপ ঢাকায় আনতে টন প্রতি আরও দুই হাজার টাকা করে খরচ পড়ে। বেশি দামে কাঁচামাল কেনার কারণে বেশি দামে রড বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, স্ক্র্যাপ এর দাম বেড়েছে তা নয়, রড তৈরিতে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তার সবগুলোই বেড়েছে। এরমধ্যে একটি কেমিক্যাল আগে কিনতাম ৭০০ ডলারে। বর্তমানে কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৭৫০ ডলারে। বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস এসোসিয়েশনের সভাপতি মানোয়ার হোসেন বলেন, রডের মূল কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহা আমদানির খরচ টনপ্রতি আগে ছিল ৪৩৫ ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যা এখন প্রায় ৫০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সব কোম্পানির সিমেন্টের দাম গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, হোলসিম ও স্ক্যান সিমেন্টের ব্যাগ প্রতি পাইকারি মূল্য ৪৬৭ টাকা। টাইগার, আমান, সেভেন হর্স, বেঙ্গল সিমেন্টের মূল্য ৪২৬ টাকা। ফ্রেশ, প্রিমিয়ার ও মীর সিমেন্ট ৪৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেভেন রিং, শাহ স্পেশাল, ক্রাউন, সুপারক্রিট, আকিজ ও বসুন্ধরা সিমেন্টের মূল্য ৪৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ কয়েকদিন আগে ফ্রেশ, প্রিমিয়ার ও মীর সিমেন্টের ব্যাগ ছিল ৪১২ টাকা। সেভেন রিং, শাহ স্পেশাল, ক্রাউন ও বসুন্ধরার পাইকারি মূল্য ছিল ৪১৮ টাকা। টাইগার সিমেন্ট, ইস্টার্ন সিমেন্ট ও সেভেন হর্স সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে ৪০৫ টাকায়। হোলসিম ও স্ক্যান বিক্রি হয়েছে ৪৪৮ টাকায়। আকিজ ছিল ৪২৫ টাকা। আমান, বেঙ্গল, গাজী, অ্যাংকর ও এলিফ্যান্টের সমেন্টের বিক্রয় মূল্য ছিল ৪০৪ টাকা। আন্তর্জাতিক সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া দ্বিগুণ বাড়ায় খুব শিগগিরই দেশের বাজারে সিমেন্টের দাম ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, সিমেন্ট উৎপাদনে প্রধান পাঁচটি কাঁচামাল ক্লিংকার, লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম ব্যবহৃত হয়, যার সবই আমদানিনির্ভর। এরমধ্যে ৬২ থেকে ৯০ শতাংশই হলো ক্লিংকার। কাঁচামাল ক্লিংকার প্রতি টন ৬০ থেকে বেড়ে ৭৫-৭৯ ডলার হয়েছে। শুধু ক্লিংকারেই ১৫ ডলারের বেশি দাম বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কাঁচামাল লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম গড়ে ১০-১২ ডলার বেড়ে গেছে। প্রিমিয়ার সিমেন্টের মহাব্যবস্থাপক গোলাম কিবরিয়া বলেন, বৈশ্বিক বাজারে গত বছরের তুলনায় বর্তমানে ক্লিংকারের দাম প্রায় দ্বিগুণ। আবার বাজারেও এ কাঁচামালের সংকট রয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে জাহাজের খরচ বেড়েছে তিন-চারগুণ। এ ছাড়া ভবন নির্মাণের মূল সামগ্রী ইট ও পাথরের দামও বেড়েছে। আগে বিদেশ থেকে প্রতি টন আমদানি পাথর বিক্রি হতো সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকায়। এই সময়ের মধ্যে প্রতি টন পাথরের দাম এক হাজার টাকা বেড়ে গেছে। এদিকে ভবন তৈরির অন্যতম কাঁচামাল ইট আমদানি করতে হয় না। তবুও দাম বাড়ছে। মাসখানেক আগে ভালো মানের প্রতি পিস ইটের দাম ছিল ১০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে সাড়ে ১১ টাকায়। দাম বাড়ার তালিকায় আছে বালু-পাথরও। ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে প্রতি বর্গফুট লাল বালু ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ টাকা বেড়ে সাদা বালু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকায়। ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক যুগের মধ্যে পাথরের দাম এখন সর্বোচ্চ। ভবন তৈরির পর দরকার হয় গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, হার্ডওয়্যার জাতীয় পণ্য। বাজারে এসব পণ্যের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী। কাওরান বাজারের আলম গ্লাস অ্যান্ড থাইয়ের স্বত্বাধিকারী আলম বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে পাঁচ মিলিমিটার পরিমাপের সাদা গ্লাস প্রতি বর্গফুটে ৭ টাকা ও রঙিন গ্লাসে ১২ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। থাই অ্যালুমিনিয়ামে প্রতি ফুটে বেড়েছে ২৭ টাকা। হার্ডওয়্যার জাতীয় পণ্যের প্রতি পিসে বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। রিহ্যাব সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম কেন বাড়ছে, তা স্পষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে প্রতিদিনই দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর বর্তমান বাজারমূল্য সমন্বয় করে বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম সমন্বয় করার দায়িত্ব গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। এ ছাড়া বেসরকারি আবাসন উন্নয়ন নীতি অনুসারে, একটি ফ্ল্যাট বিক্রয় চুক্তির ৬ মাসের মধ্যে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, অযৌক্তিক অকাট্য তথ্য দিয়ে দিয়ে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব না থাকলে ভোক্তারা সারাজীবন ঠকেই যাবেন।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!ডায়ালসিলেট এম/

