মনু নদীর বাঁধ স্থায়ী সংরক্ষণে ১ হাজার কোটি টাকার কাজে অনিয়মের অভিযোগ

প্রকাশিত: ২:২৭ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০২২

মনু নদীর বাঁধ স্থায়ী সংরক্ষণে ১ হাজার কোটি টাকার কাজে অনিয়মের অভিযোগ

মনজু চৌধুরী: মৌলভীবাজারের দুংখ”খ্যাত নদের নাম হচ্ছে মনু নদী।বছরের পর বছর দুই তীরে ভাঙ্গছে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট হাটবাজার ফসলের মাঠ।মনু নদীর ভাঙ্গানে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে।
তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পের ২ বছর পার হলেও চোখে পড়েনি দৃশ্যমান অগ্রগতি। কাজের এই ধীর গতিতে স্থানীয়রা আশংকা করছেন আগামী বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পাহাড়ী ঢল নেমে আসলে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হবে।
খড় – স্রোতা মনু নদীর ভাঙন রোধে এবং বন্যার স্থায়ী সমাধানে একনেকে হাজার কোটি টাকার “মনু নদের ভাঙন থেকে কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর রক্ষা” প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। মৌলভীবাজার জেলাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবির প্রেক্ষিতে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করে সরকারের এই মেগা প্রকল্পের অর্থ নয়ছয়ে ব্যস্ত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যোগসাজেসে এমনটি হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ‘মনু নদের ভাঙন থেকে কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর রক্ষা’ নামে ওই প্রকল্প ২০২০ সালের জুন মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৯’শ ৯৬ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা। ২০২৩ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ২ বছরে মাত্র ২৩ শতাংশ কাজ হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এতো টাকা ব্যয়ে মনুনদীতে এমন প্রকল্প হাতে নেয়নি কোনো সরকার। নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করায় সরকারের ৯’শ ৯৬ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা ঠিকই ব্যয় হবে কিন্তু এলাকাবাসীর উপকারে আসবে না। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিল তোলার জন্য নামকাওয়াস্তে কাজ করছে। তারা বলছেন, আগামীতে এতো বড় প্রকল্প পূণরায় আসবে বলে মনে হয়নি। মেগা প্রকল্পের কাজে আমাদের দূর্ভোগ না কমে বরং স্থায়ী রূপ নেবে।
সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পে ৭২টি প্যাকেজে কাজ হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে ৭০টির টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৫৮টি’র এবং এর মধ্যে ৪৫টি প্যাকেজের কাজ চলছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩০ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ, আড়াই কিলোমিটার নতুন ফ্লাড ওয়াল নির্মাণ, ৭৬৫ মিটার পুরাতন ফ্লাড ওয়াল নির্মাণ, ৮৬ কিলোমিটার মনুবাদ শক্তিশালী করণ, ১২ কিলোমিটার চর অপরারণ ও ২২৮ একর ভুমি অধিগ্রহণ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বল্ক নির্মাণে নির্ধারিত (সিলেকশন গ্রেড) বালু ও পাথর ব্যবহার করার শর্ত থাকলেও স্থানীয়ভাবে নদী থেকে তোলা বালু ও পূর্বে ব্যবহারকৃত নিম্ন মানের পাথর ব্যবহার হচ্ছে। ফলে নির্মিত বল্কগুলো নিয়ে আশংকা করছেন স্থানীয়রা। আবার অনেক জায়গায় নদী থেকে কাদা মিশ্রিত বালু তুলে জিও ব্যাগ ভরার অভিযোগ রয়েছে। যার গুণগতমান নিয়ে স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পে ঘানি ব্যাগ ব্যবহারের কথা থাকলেও কোথাও এর দেখা মেলেনি।
সরেজমিন মনু প্রকল্পের আওতাধীন রাজনগর উপজেলার কোনাগাঁও-খেয়াঘাট গেলে দেখা যায়, বল্ক তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের পাথর ও বালু। পাথরের সাথে সিমেন্ট মিশ্রিত দেখে ধারণা করা হচ্ছে পূর্বে কোথায় এই পাথর গুলো ব্যবহার হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে জিও ব্যাগ গুলো নদীতে ফেলা হয়। কামারচাক বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মনু নদীর মধ্যখানে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে এবং অনেক জিও ব্যাগ চরে বালির নিচে তলিয়ে গেছে। দস্তিদারেরচক, টগরপুর, আদিনাবাদ, খাসপ্রেমনগর, ভোলানগর-মিঠিপুর ও প্রেমনগর অংশে একই চিত্র। খাসপ্রেমনগর এলাকায় গেলে দেখা যায়, টাস্কফোর্স জিও ব্যাগ চিহ্নিত করে যাওয়ার পরেও নদীর চরে পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। অথচ সরকারি নির্দেশনা রয়েছে টাস্কফোর্স জিও ব্যাগ গণনা করার ১৫ দিনের মধ্যে নদীতে সংশিষ্ট স্থানে ফেলার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাগ গুলো নদীতে না পেলায় জিও ব্যাগের গুণগতমান কমে যাচ্ছে। এদিকে স্থানীয়রা বলছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় রয়েছে। নদীতে পানি বাড়ার সাথে সাথেই জিও ব্য্যগের সেলাই কেটে দিলে জিও ব্যাগ গুলো নদীতে ভেসে যাবে। ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ এলাকায় নেই সাইট অফিস কিংবা ব্যয় নির্দেশিকা সাইন বোর্ড। অথচ প্রকল্পে সাইট অফিস স্থাপনের জন্য রয়েছে বরাদ্দ।
খাসপ্রেমনগর এলাকার যুবলীগ নেতা সিরাজ ও মোহাম্মদ আলী সহ অনেকে বলেন, মেগা প্রকল্পের কাজের কোনো অংশই সঠিক নিয়মে হচ্ছে না। সরকারের ওই টাকা নদীতে ভেসে যাচ্ছে। ঠিকাদাররা বিল তুলে নেয়ার জন্য নামমাত্র কাজ করছে। অপরিকল্পিত কাজ আমাদের কোন কাজে আসবেনা। তিনি বলেন, এভাবে কাজ করলে আমরা নদী ভাঙ্গন থেকে কোন দিন মুক্তি পাবও না।
কামারচাক বাজার এলাকার মহব্বত উল্ল্যাহ, আব্দুল করিম, ব্যবসায়ী তছির আলী ও সাজিদ আলী বলেন, খরচ বাঁচানোর জন্য বস্তা (জিও ব্যাগ) নদীর পাশে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না পেলে নদীর তল দেশে ফেলা হয়েছে। অনেক বস্তা এখনও চরে বালির নিচে রয়েছে। বর্ষা আসলেই চরের বস্তাগুলো ¯স্রোতের টানে চলে যাবে। এদিকে টাস্কফোর্স গণনা করে যাওয়ার পরেও অনেক বস্তা নির্ধারিত জায়গায় ফেলা হয়নি।
রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ও জাতীয় শ্রমিকলীগ রাজনগর উপজেলা শাখার যুগ্ন আহবায়ক মিজানুর রহমান খান বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্টানের অনিয়মের কারণে এই প্রকল্পের কাজ এলাকাবাসীর কোন কাজে আসবে না। বরং আমাদের ক্ষতি হবে। অনেক জিও ব্যাগ চরের মধ্যে তলিয়ে গেছে। যে গুলো কাজে লাগবে না। বর্ষা আসলেই স্রোতেরটানে ভাটিতে তলিয়ে যাবে।
দস্তিদারেরচক এলাকার ফারুক মিয়া, আয়াজ আহমদ ও আবুল কালাম ছানু বলেন, আমাদের এলাকায় নদী খনন না করে নদীর পাড় কেটে নদীর তলদেশে মাটি পালানো হয়েছে। এটা আমাদের জন্য আরও বিপদজনক।
মুন ইন্টারন্যাশনাল এর সত্তাধিকারী মিজানুর রহমান বলেন, ওয়ার্ক অর্ডারের চেয়ে আরও ভালো মানের কাজ হচ্ছে। আমার সাইটের বল্ক বুয়েট পরীক্ষা করে স্বীকৃতি দিয়েছে। এলাকার মানুষ অনেক কিছু বলতে পারে। এম এম বিল্ডার্স এর ম্যানেজার মোঃ সুহান আলী নিম্নমানের পাথরের কথা স্বীকার করে বলেন, এই পাথর দিয়ে আপাদত বল্ক তৈরি বন্ধ রাখা হয়েছে।
কামারচাক ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আতাউর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে ১০টি প্যাকেজে কাজ চলছে। কাজগুলো মানসম্মত হচ্ছেনা। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেও এর সমাধান হচ্ছেনা। তাই এই কাজ নিয়ে আমরা শংঙ্খিত।
নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, কাজের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য আমরা সর্বদা তৎপর। টাস্কফোর্সের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া প্রকল্পের কোনো কাজ চুড়ান্ত হচ্ছে না। টাস্কফোর্সের গণনাকৃত জিও ব্যাগ ও বল্ক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজে না লাগিয়ে মাসের পর মাস পড়ে আছে। যার কারণে কাজের গুণগতমান অনেকটা কমে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিস্থিতির কারণে সর্বোচ্চ ৫/১০ দিন বেশি সময় দেয়া যেতে পারে। তবে এর বেশি রাখা ঠিক নয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও উপকার ভোগীরা কাজের গুণগতমান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা কাজ সম্পর্কে কি বুঝেন।

0Shares

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ