স্টাফ রিপোর্টার॥ ‘রাত অইলে (হলে) ঘুম লাগেনা সাপ ও আফালের ডরে (ঢেউয়ের ভয়ে)। পানি এইবার খুব আস্তে কমের (ধীরগতিতে কমছে)। আকাশ মেঘলা অইলে (হলে) আরো ডর (ভয়) করে, বৃষ্টিতে যদি আবারো পানি বাড়ে (বৃদ্ধি পায়)। এমন কথাগুলো বলছিলেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি তীরবর্তী বরমচাল ইউনিয়নের লামা মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা আছিবুন বেগম (৬২)।
আছিবুন বেগম বলেন, এইবার বন্যায় ঘরের ভিতর হাঁটু পানি প্রবেশ করায় ১২ দিন আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন ছেলে, পুত্রবধু ও নাতি-নাতনী নিয়ে। ঘর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় দুইদিন ধরে বাড়িতে ফিরে এসেছি। ঘরের ভিতর সব পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরের মাটির মেঝে এবং বেড়াও নষ্ট। আমার ছেলের আয়-রোজগার নেই। কিভাবে চলবো আর কিভাবে ঘর ঠিক করবো। এখনো বাড়ির উঠোনে পানি। এই পানিতে জোঁক ও সাপ রয়েছে। রাত হলে পাহারা দেই নাতি-নাতনীকে যদি সাপ ঘরে ঢুকে কামড় দেয়।
সরেজমিনে উপজেলার ভূকশীমইল, বরমচাল ও ভাটেরা ইউনিয়নে বন্যা প্লাবিত এলাকায় গিয়ে জানা যায়, গত ১৭ জুন থেকে কুলাউড়ার হাকালুকি তীরবর্তী এলাকাসহ উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম ও পৌর এলাকার অধিকাংশ বন্যায় প্লাবিত হয়। ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো বন্যার পানির নিচে ওইসব এলাকার অধিকাংশ বাড়ি, বাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট। পানি খুবই ধীরগতিতে কমছে। অনেকের ঘরের ভিতর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে দুর্ভোগে পড়েছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে পড়ছেন। পাকের চুলা, বিছানাপত্র পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে অনেকের। এইবারের দীর্ঘ বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে কর্মহীন অবস্থায় দিনযাপিত করছেন। এখনো পানি নামেনি। দীর্ঘদিন পানি ও ঢেউয়ে অনেক কাঁচা বসতঘর নষ্ট হয়ে গেছে। পানিবাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
জাব্দা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর নূর বলেন, ‘আমার ঘর থেকে এখনো পানি নামেনি। আশ্রয়কেন্দ্রে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে আছি। পানি যেনো আটকে আছে, কমছেইনা। ঘরের টিনের বেড়া হেলে গেছে। কাজ নেই, তাই আয় রোজগারও নেই। অভাবে আছি, ঘর কিভাবে সংস্কার করবো। বন্যার পানি চলে যাবে। কিন্তু পরিবারে থাকা-খাওয়া কিভাবে চালাবো, এই দুশ্চিন্তায় আছি।’
ভাটেরার শাহমীর এলাকার বাসিন্দা নজরুল মিয়া বলেন, ‘এখনো ঘরের ভিতর পানি হাঁটু সমান। হাকালুকিতে বন্যা দেখেছি। এইবারের মতো জীবনে কখনো বাড়িতে পানি ওঠেনি। মা স্ত্রী ও ছোট্ট শিশুকে ইসলামনগরে শশুরবাড়িতে রেখেছি। নিজে বাড়ির কাছে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেছি। প্রতিদিন বাড়ি দেখতে হয়, ঘরের ভিতর আসবাবপত্রসহ অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে।’
ভাটেরা ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ একেএম নজরুল ইসলাম জানান, ‘হাকালুকি তীরবর্তী হওয়ায় আমার ইউনিয়নের শাহমীর, নওয়াগাঁও, বেড়কুড়ি, হরিপুর এলাকায় হাওরের ঢেউ আছড়ে পড়ে। এতে ওইসব এলাকার কাঁচা-পাকা ৮ কিলোমিটার সড়ক বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া বেশকিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি বন্দি এখনো ৫ হাজার পরিবার। ওইসব এলাকার মানুষ অধিকাংশই দরিদ্র দিনমজুর। দীর্ঘ বন্যায় কর্মহীন ও ঘরবাড়ি ছাড়া রয়েছেন অনেকেই।’
এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, কুলাউড়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরীর কাজ করছি। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বন্যা পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া আছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নিতে। আমরাও খোঁজ রাখছি। ত্রাণের সাথে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রসহ পান বন্দি মানুষকে প্রতিদিন সরবরাহ করা হচ্ছে।
