ডায়ালসিলেট ডেস্ক॥ কিতাগো ইবার দেখি তোমার বাবার বাড়ি থাকি ইফতারি আইল না।’ মুচকি হাসি হেসে এমন কথাগুলো বলছিলেন রোজী আক্তারের (ছদ্মনাম) চাচা শ্বশুর। হাসির ছলে এ কথা বললেও তিনি কিন্তু মন থেকে বলেছেন। রোজীর মনে দাগ কাটে, কারণ এবছর এখনও বাবার বাড়ি থেকে আসেনি ইফতার সামগ্রী।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে রোজী আক্তারের মতো অনেক মেয়েরা রমজান মাসে অপেক্ষায় থাকেন, কখন আসবে বাবার বাড়ি থেকে ইফতার। অপেক্ষায় থাকলেও তিনি জানেন, তার বাবার আর্থিক দুরাবস্থার কথা।বাবার বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে আসা ইফতার-এ অঞ্চলের প্রচলিত অনেক প্রথার মতোও একটি প্রথা। ইফতারের প্রথা বাবাদের গলার কাঁটা হয়ে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

ইফতার পাঠানো নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে এ অঞ্চলে। কার শ্বশুরবাড়ি থেকে কত ভালো ইফতার সামগ্রী এলে, কে তার শ্বশুরবাড়ির ইফতার খাওয়াতে কতবেশি মানুষকে দাওয়াত করলো। এসব নিয়ে চলে নীরব প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় পিষ্ট হতে হয় অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছলদের। ফলে এই প্রথা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে জোরেশোরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মেয়ের বাড়িতে ইফতার’ পাঠানোর বিরুদ্ধে বলছেন অনেকেই। মেয়ের বাড়িতে ইফতারকে না বলুন এমন আওয়াজও উঠেছে।

বাবার বাড়ি থেকে মনের মতো ইফতার না আসলে শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছ থেকে নানান কটুকথা শুনতে হয় মেয়েদের। হয়তো সেই মেয়ে জানে তার বাবার আর্থিক অবস্থা। ইফতার দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার বাবার নেই। কিন্তু নিজের বাবার সম্মানের কথা ভেবে, শ্বশুরবাড়িতে নিজের সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে অনেক সময় ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়ে সে তার বাবাকে অনুরোধ করে। বাবাও আবদার ফেলতে পারেন না। জমি বন্ধক দিয়ে অথবা গরু বিক্রি করে যেভাবেই হোক ইফতার সামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।

মৌলভীবাজার শহরের কয়েকজন প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই অঞ্চলে ইফতার প্রথা পুরাতন এক ঐতিহ্য। বাবার বাড়ি থেকে রমজানে মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানো হয়। সে ইফতার শুধু সেই বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। যেদিন ইফতার আসবে, সেদিন পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবসহ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে চলে নীরব এক প্রতিযোগিতা। কার শ্বশুরবাড়ি থেকে কত বেশি পদের ইফতার এল। কে কতজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালো। যার শ্বশুরবাড়ি থেকে যত বেশি ইফতার আসে তার তত সুনাম। তেমনি যে বাবার সেই সক্ষমতা কম, সেই বাবার মেয়েকে অনেক ক্ষেত্রে শুনতে হয় কটু কথা।

এই প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম। তারা এটাকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, মেয়ের বাড়িতে ইফতার দেওয়াটা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের জন্য মেয়ের মুখ বড় করতে গিয়ে বিত্তের প্রদর্শনীতে পরিণত করা হচ্ছে। আবার দরিদ্র মা-বাবাকে এই প্রথা পালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হতে হয়।

সংস্কৃতিকর্মী হেলাল আহমদ বলেন, এই প্রথাটা আসলেই বিলুপ্ত হওয়ার দরকার। আমি নিজেও ইফতার নিয়ে অনেক মেয়েকে লাঞ্চিত হতে দেখেছি শ্বশুরবাড়িতে। শহরে এখন কম দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখনও এই প্রথা চালু আছে। অনেক বাবার সাধ্য নেই ইফতার পাঠানোর। তাদের মেয়েরাই সাধারণত শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্চনার শিকার হয়ে ননদ, শাশুড়ির কটু কথা শুনতে হয়। একজন সংকৃতিকর্মী হিসেবে এই প্রাচীন প্রথা মানতে পারি না।

এ বিষয়ে সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ আসম ছালেহ সোহেল বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে মেয়ের বাড়িতে ইফতারের সংস্কৃতি বহু বছর ধরেই চলছে। কিন্তু এটি চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি নয়, বরং তা ছিল বিত্তশালী বাবার মেয়ের প্রতি ভালোবাসার একটা প্রকাশ। কিন্তু বর্তমানে এসে উল্টোটা হচ্ছে। আমি মনে করি এটি বিলুপ্তি বা চালু রাখা এই তর্কে না যেয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িকে বোঝানো ভালোবাসা প্রকাশে বাধ্য করতে নয় বরং তার সামর্থের বা ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া। এটাকে অমানবিক না করে মানবিক সংস্কৃতিতে দেখা বোধহয় যুক্তিযুক্ত হবে।

যুগ যুগ ধরে চলা এমন অমানবিক প্রথা সমাজ থেকে নির্মূল করতে সবাইকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে এখনই সচেতন হতে হবে জানিয়ে গণমাধ্যম কর্মী আব্দুর রব বলেন, সবার জন্য এই প্রথা থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে সবার অবস্থা এক না থাকায় অনেক মেয়ের বাবাকে রোজার মাসে ইফতার পাঠাতে গিয়ে যেতে হয়ে এক মানসিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে। নিন্মআয়ের মানুষদের মধ্যে এ এক ভীতিকর সামাজিক নিয়ম। যা সেই সব বাবারই বুঝেন।শিক্ষক জাহাঙ্গীর জয়েস বলেন, প্রথা যখন নিয়ম হয়ে যায় তখন বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের কাছে সেটা মারাত্মক বোঝা হয়ে দেখা দেয়। এ নিয়ে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি, নির্যাতন পর্যন্ত হচ্ছে। এটা তখন ব্যাধির মতো হয়ে যায়। এ ধরনের প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

মাওলানা রাজন আহমদ বলেন, বাবার বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে রমজানে ইফতার পাঠানো আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি কুসংস্কার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে এই কুপ্রথা এখনও শেকড় ঘেড়ে আছে। অনেকে মনে করেন, মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে বাহারি ইফতার পাঠালে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়। তাই বিত্তবানরা জৌলুসপূর্ণ ইফতারি পাঠান। আবার অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ইফতার না পাঠালে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছ থেকে কটুকথা শুনতে হয়, তাই বাধ্য হয়ে অনেক বাবা-মা ধারদেনা করে হলেও মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠান।

তিনি আরও বলেন, শুধু অশিক্ষিত পরিবারগুলোতেই যে এর ছড়াছড়ি তা নয়, সমাজের সচেতন অংশ এমনকি শিক্ষিত পরিবারেও লেগেছে এই অভিশাপের ছোঁয়া। মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানো নামক অমানবিক প্রথা সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *