ডায়াল সিলেট ডেস্ক: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীদের ভোগান্তির যেন কোন শেষ নেই। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী কর্তৃক রোগীদের পড়তে হয় হয়রানিতে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এখানে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসলে হাসপাতালের নার্স থেকে শুরু করে জরুরী বিভাগের সহকারীদের দিতে হয় ১০০-৫০০ টাকা। টাকা না দিলে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে রোগীদের অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়। এমন সব বিস্তর অভিযোগ থাকলেও হাসপাতাল পরিচালনার ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে তদারকি করতে ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি হাসপাতালের প্রধান কর্তাব্যক্তি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে। তাঁর নীরবতাই যেন হাসপাতালটি এখন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার আতুরঘরে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৫ অক্টোবর রাতে চিকিৎসা নিতে আসা ছোট্ট এক শিশুর স্বজনদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সহকারী কর্তৃক টাকা না দেয়ার কারণে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। খবর পেয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমান হাসপাতালে ছুঁটে আসেন। এমন অনিয়মের বিষয়টি তিনি তাৎক্ষণিক হাসপাতালের ইউএইচএফপিও এবং জেলা সিভিল সার্জনকে অবহিত করেন। এরপর হাসপাতালের এমন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ ফেরদৌস আক্তারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে তার প্রতি ক্ষোভ ঝাড়লেন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি সফি আহমদ সলমান। পরে তাঁর হস্তক্ষেপে হাসপাতালে আসার ৪ ঘন্টা পর ওই রোগী ভর্তির সুযোগ পায়। এই ঘটনায় জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ পরদিন ১৬ অক্টোবর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সহকারী জুয়েল দাসকে স্ট্যান্ড রিলিজ করেন এবং এমন ঘটনার জন্য জেলা সিভিল সার্জন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে হাসপাতালে গেলে কথা হয় উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের পুরশাই গ্রামের বাসিন্দা তানভীর হোসেন ও তার স্ত্রী তানজিলার সাথে। তারা অভিযোগ করে বলেন, ৪ মাস বয়সী তাদের সন্তান আব্দুল্লাহ ৬দিন ধরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। গত ১৫ অক্টোবর রাত দশটায় ভর্তি করার জন্য কুলাউড়া হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যান। তখন জরুরী বিভাগের চিকিৎসক তাকে ভর্তি করার কথা জানান। এসময় হাসপাতালের ইমার্জেন্সি এটেনডেন্ট জুয়েল দাস ও ব্রাদার রাসেল মিয়া তাদের বলেন, হাসপাতালে ভর্তির জন্য কোন সিট নেই, টাকা দিলে সিট দেয়া হবে। এরপর ছেলের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সেখানে যাওয়ার পর দায়িত্বরত নার্সরা ওই শিশুর ক্যানোলা লাগাতে পারেননি। তখন আবারো ক্যানোলা লাগানোর জন্য তাদের ছেলেকে জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন জুয়েল দাস বলেন, ১১০ টাকা দিলে ক্যানোলা লাগিয়ে দিবেন। টাকা দিতে আমরা অস্বীকৃতি জানাই। তখন তারা উল্টো বলেন বাড়ি চলে যেতে বা মৌলভীবাজার চলে যেতে। এদিকে আমাদের পরে হাসপাতালে এসে আরো দুই শিশু রোগীকে জরুরী বিভাগে নিয়ে আসলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অথচ আমরা দীর্ঘসময় হাসপাতালের বারান্দায় অসুস্থ শিশুটিকে নিয়ে বসে থাকি। ভর্তি করতে না পেরে ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে দ্বিতীয় তলার ওয়ার্ডে ৬-৭ বার উঠানামা করি। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমদ সলমান মহোদয় হাসপাতালে আসলে উনাকে বিষয়টি জানালে তিনি আমাদের কথা শুনে বাচ্চাকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন।
হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং হাসপাতালের আবাসিক ওয়ার্ডের কিছু নার্সদের দ্বারা তাদের পড়তে হয় হয়রানিতে। তারা তাদের সাথে খারাপ আচরন করেন। এছাড়া ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে শুধু তাদের স্যালাইন দেয়া হয়। কোন ওষুধ দেয়া হয়না। বাকি সকল ওষুধ বাইরে থেকে বাড়তি টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। তারা আরো বলেন, হাসপাতালের বাথরুম, বেসিন ও ফ্লোরের অবস্থা খুবই অপরিচ্ছন্ন। গত তিন দিন ধরে মহিলা ওয়ার্ডের ফ্লোর মুছা হয়নি, শুধু ঝাড়ু দেয়া হয়েছে। দায়িত্বরত ব্যক্তিকে পরিস্কার করার কথা বললে সে হুংকার দিয়ে বলে উল্টো আমরা পরিস্কার করতে। এই নোংরা পরিবেশের মধ্যে হাসপাতালের বেডে থেকে আমাদের নাকে কাপড় দিয়ে থাকতে হয়। এভাবে কয়েকদিন আমরা ভর্তি থাকলে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বো।
এদিকে ৫দিন ধরে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি হয় উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের মহেষগৌরি এলাকার বাসিন্দা এবাদুর রহমানের ২ মাস ২০ দিন বয়সী মেয়ে আদিবা রহমান। এবাদুর রহমান জানান, ১৬ অক্টোবর দুপুরে তার মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করান। আগেরদিন রাতে ওই মেয়ের হাতে ক্যানোলা করতে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি এটেনডেন্ট জুয়েল দাস ১০০ টাকা উৎকোচ নিয়ে ক্যানোলা করে দেন।
অন্যদিকে আরেক রোগীর স্বজন ছায়ারুন বেগম বলেন, গত তিন দিন ধরে আমার অসুস্থ নাতিনকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। কিন্তু এই তিন দিনেও বেডসিটের কোন চাদর পাইনি। নোংরা চাদরে কোনমতে দুর্গন্ধ মাখিয়ে অসুস্থ নাতিন ও আমার মেয়েকে নিয়ে আছি।
জয়চন্ডী ইউনিয়নের কামারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, ৭ মাস বয়সী আমার মেয়ে হাবিবা ৬দিন ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করি। কিন্ত হাসপাতাল থেকে শুধু স্যালাইন পেয়েছি। বাকি সকল ওষুধ বাহির থেকে কিনেছি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফেরদৌস আক্তার রোগীদের করা সকল অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, সব অভিযোগ সত্য নয়। আমরা রোগীদের আন্তরিকভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তারপরও যেসকল কর্মচারী-নার্সরা রোগীদের সাথে খারাপ আচরণ করছেন তাদের সতর্ক করে দিবো। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিচ্ছন্নতা পদে জনবল সংকট থাকলেও প্রতিদিন ১জন কর্মীকে দিয়ে কোনমতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। ওষুধ সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারিভাবে যে ওষুধ সাপ্লাই আছে সেগুলো রোগীদের দেয়া হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। আর রোগীর স্বজনের কাছ থেকে টাকা চাওয়াসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সকল অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমান বলেন, হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছে রোগীরা অভিযোগ করার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার সতর্ক করেছি। গত সোমবার রাতে হাসপাতালে গিয়ে দেখি এক অসহায় মহিলা তার বাচ্চাকে ভর্তি করার জন্য হাসপাতালের বারান্দায় কাতরাচ্ছে। পরে বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের ইউএইচএফপিওকে জানার পর ওই বাচ্চাকে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *