ডায়াল সিলেট ডেস্ক:-
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!ঢাকা-সিলেট ছয় লেন মহাসড়ক প্রকল্পের কাজে ধীরগতির কারণে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। অন্যদিকে অধিগ্রহণ করা জমির টাকা না পাওয়ার অভিযোগও তুলেছেন অনেকে। কখন শেষ হবে এই প্রকল্প, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে ।
এই প্রকল্পের কাজে অপরিকল্পিত ব্যয় ধরা হয়েছে বলে ধারণা সচেতন মহলের। দেশের সবচেয়ে আলোচিত এই মহাসড়কের ছয় লেনের কাজের ক্ষেত্রে ভূমিমালিক ও ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও তাদের টাকা বুঝে পাননি।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে , ভূমি অধিগ্রহণ জরিপে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে–এমন অভিযোগ উঠেছে । জরিপ কর্মকর্তারা নানা সুবিধা নিয়ে, কম মূল্যের বিভিন্ন স্থাপনাকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় ধরেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে নানা সমালোচনা বিরাজ করছে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাসড়কের পাশে রয়েছে বিভিন্ন বাজার, গার্মেন্টস কারখানা, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, বাসা, বাড়ি, পেট্রোল পাম্প, সিএনজি পাম্প, কমিউনিটি সেন্টার, ফসলি জমি ও খেলার মাঠ। জরিপের কাজে যখন এসব স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ধরা হয়, তখন কিছু এলাকায় স্থাপনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে।
এছাড়া জমির মূল্য দলিল অনুযায়ী ধরা হলে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম ধরা হয়েছে। এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মে মাসে জমি অধিগ্রহণের টাকার নোটিশ দেওয়া হয়। এখনও ভূমির মূল্য দেওয়া হচ্ছে না এবং বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো স্থাপনার ক্ষতিপূরণের নোটিশ দেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি কমিউনিটি সেন্টারের আংশিক ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। আবার কোনো কোনো মুদি দোকানের ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। জমির বাজার মূল্য যেখানে প্রতি শতক ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা সেখানে ধরা হয়েছে ২ লাখ টাকা। আবার ২ লাখ টাকার মধ্যে ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা করে প্রতি শতক।
আউশকান্দি বাজার এলাকায় জমির শতক হচ্ছে ৭ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা, সেখানে শতক ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। মিটাপুর মৌজায় ৭ লাখ টাকার মধ্যে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মিনাজপুর মৌজায় ধরা হয়েছে ৩ লাখ টাকার মধ্যে ৭৫ হাজার টাকা শতক, ২ লাখ টাকার মধ্যে দেওতৈল মৌজায় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা শতক।
এ ছাড়াও পরিকল্পনা ছাড়া মহাসড়কের নির্মাণকাজ চলছে। ফলে প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতকারী যাত্রীদের কাছে এখন আতঙ্কের নাম এই মহাসড়ক। নবীগঞ্জ থেকে ৪ ঘণ্টার রাস্তা ঢাকা যেতে এখন সময় লাগছে ১০ ঘণ্টা। যানজটে আটকা পড়লে সেটি ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লাগার নজির রয়েছে। ফলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রীদের ভোগান্তি এখন আকার ধারণ করেছে।
মহাসড়কের নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের কার্যালয়ে বৈঠক হলেও কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। ইতোমধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছাড়াও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে কাজের ধীরগতির জন্য বৈঠক করেছেন। এর কারণ নির্ণয় করে মহাসড়কের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে প্রকল্পের প্রধান ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা ফজলুল করিম জানিয়েছেন, এই সড়কটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০২১ সালে। সমাপ্ত ওয়ার কথা ছিল ২০২৬ সালে। প্রকল্পটির নাম হচ্ছে সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর-ছয় লেন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছিল সব মিলিয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের জন্য ৭টি জেলা থেকে মোট ৮২৯ দশমিক ৮৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।
তিনি আরও জানান, ২০৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ওই সড়কের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে মাত্র ১৫ ভাগ। এখনও ৮৫ ভাগ ভূমি অধিগ্রহণ করার বাকি রয়েছে। যদি আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তিনি ভূমি বুঝে পান তাহলে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবেন। কেবল ভূমি জটিলতার কারণে এই সড়কের নির্মাণকাজ আটকে আছে। ভূমি না পাওয়ায় সড়কের নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকরা বসে আছেন। তাদের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। ভূমি বুঝে না পাওয়ার কারণে কাজ এগোচ্ছে না।
প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ফজলুল করিম জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এই প্রকল্পের আওতায় ৬৬টি ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে ৬০টি ব্রিজের কাজ চলমান রয়েছে। ৩০৫টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। ২০০টির বেশি কালভার্টের কাজ শেষ হওয়ার পথে রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ফ্লাইওভারেরও কাজ করা হবে। দুই পাশে সার্ভিস লেনও নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া সড়কটির টেকসইয়ের জন্য মডিফাই বিটুমিন ব্যবহার করা হবে।
এদিকে এই প্রকল্পের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, ভূমি অধিগ্রহণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণ করা ভূমি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাছে সমঝে দেওয়ার জন্য দ্রুত কাজ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ছয় লেন নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে ও ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রমে অগ্রগতি ফেরাতে মহাসড়কের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেছেন সিলেট জেলা প্রশাসক সারোয়ার আলম ও হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফরিদুর রহমান। এ সময় মহাসড়কের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করতে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ বাস্তবায়নে মহাসড়কের পাশে সরকারি জায়গা দখল উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেন তারা। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের ছয় লেন কাজের গতি ঠিক রাখার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা দখলমুক্ত রাখতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মহাসড়কের হোটেল ব্যবসায়ী লুবন মিয়া বলেন, কাগজপত্র নেওয়া হলো তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে কিন্তু এখনও কোনো হদিস পাচ্ছেন না। আসলেই ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা জানেন না।
ভূমি মালিক আব্দুল করিম জানান, তাদের এলাকায় দলিল অনুসারে জমির দাম অধিগ্রহণ করায় বিপাকে পড়েছেন। কারণ মানুষ ৭ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা শতক জমি কেনে দলিলে লিখেছেন এক লাখ টাকা শতক। সে কারণে বাজার মূল্য পাচ্ছেন না তারা। এনিয়ে বার বার আবেদন করেও কোনো সুরাহা হয়নি।
ভূমি মালিক ফরিদ মিয়া জানান, তাঁর জমি আউশকান্দি ও মিঠাপুর মৌজায় পড়েছে। এখনও কোনো টাকা পাননি। কবে পাবেন তাও জানেন না। শুনেছেন জমির দাম নাকি তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
আরেক ভূমিমালিক আব্দুল জব্বার বলেন, এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। তাদের কাছে গত মে মাসে আবেদন চাওয়া হলে টাকার জন্য আবেদন করেন। এখনও টাকা দেওয়া হয়নি। অধিগ্রহণকৃত ভূমির টাকার জন্য প্রতিদিন ঘোরাঘুরি করছেন। ফরহাদ আহমদ নামে একজন ভূমিমালিক বলেন, গ্রামের মসজিদের কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেজন্য আবেদন করেছেন কিন্তু কোনো টাকা পাননি।
রহমান কমিউনিটি সেন্টারের মালিক মুহিবুর রহমান হারুন বলেন, তাঁর সেন্টারটির বেশির ভাগ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা হিসাবে। এখনও কোনো টাকা পাননি। তাঁর চারপাশে কাজ শুরু হয়ে গেছে কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না।
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমীন জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নির্মাণকাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করতে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ ত্বরান্বিত করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। সেই লক্ষ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণের দুই-তিনটি মামলা সমাপ্ত হয়েছে। কয়েকজনকে টাকা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া, সেজন্য দেরি হচ্ছে। স্থাবর সম্পত্তি হুকুমদখল আইন ২০১৭ অনুযায়ী বাজার মূল্যে অধিগ্রহণকৃত জমির দাম দেওয়ার সুযোগ নেই। দলিল মূলে যে দাম সেটি দেওয়া হবে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের সিলেট অংশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন বলেন, অধিগ্রহণকৃত জমি এখনও সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এইজন্য কাজের গতি নেই। যেটুকু জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ২০ ভাগ কাজ হয়েছে। কাজের গতি বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়েছেন। দ্রুত এগিয়ে নিতে কাজ চলমান রয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, হয়তো শ্রমিক সংকটের কারণে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ করেছে। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেসব স্থানে ঘন ঘন কালভার্ট ও ব্রিজ হচ্ছে সেগুলো আগেই নির্ধারিত। নতুন করে কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। পাহাড়ি এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য নবীগঞ্জ ও বাহুবল এলাকায় ঘনঘন কালভার্ট করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমানকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। তাঁকে হোয়াটস এপে সংবাদের বিষয়বস্তু লিখে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।
হবিগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মঈনুল হক বলেন, জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ। এখন দ্রুত টাকা দেওয়া হবে। নানা জটিলতার জন্য অধিগ্রহণের টাকা দিতে দেরি হয়েছে। ৩৭টি ভূমি (এলো কেস) মামলার মধ্যে চারটি মামলার কাজ শেষ করে জমি বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাকিগুলো এক মাসের মধ্যে অধিগ্রহণের টাকা দিয়ে জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণ জটিলতার জন্য কাজের কোনো বিঘ্ন ঘটছে না।

