ডায়াল সিলেট ডেস্ক:-
সিলেট বিভাগের আটটি নির্বাচনি আসনের ভোটের মাঠে বিএনপির উত্তরসূরি উত্তাপ ভর করছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপি-নেতার উত্তরসূরি হিসেবে তৎপর আছেন অন্তত ৯ জন।
দলীয় পরিচয় ছাপিয়ে তাদের জনপরিচিতি পূর্বসূরির উত্তরসূরি হিসেবে। এ পরিচয়ে বেশ সাড়া পাচ্ছেন বলে তারা আটঘাট বেঁধে নেমেছেন ভোটের মাঠে।
সংসদীয় আসন ঘেঁটে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৯টি সংসদীয় আসনের মধ্যে হবিগঞ্জ জেলার আসন ছাড়া বাকি তিনটি জেলার আটটি নির্বাচনি এলাকায় উত্তরসূরিরা তৎপর। এর মধ্যে সংখ্যা বেশি সিলেটে। এখানে উত্তরসূরি হিসেবে তৎপর ছয়জন। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন মৌলভীবাজারে ও দুজন সুনামগঞ্জে।
উত্তরসূরি উত্তাপে বিএনপি রাজনীতির সাবেক নেতাদের অনুসারীদেরও বিশেষভাবে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। তাদের মাধ্যমে অতীতে বিএনপি রাজনীতির মাঠ কাঁপানো ঘটনাবলিও স্মরণের মধ্যে আসছে। কারও মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত, কারও মনোনয়ন প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় তাদের কোণঠাসা করার তৎপরতাও রয়েছে। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পূর্বসূরির বলে বলীয়ান হওয়ায় তাদের পক্ষে প্রচারণার স্বতঃস্ফূর্ত দিক রয়েছে।
স্বামীর শূন্যতায়
সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনে ২০০১ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এম ইলিয়াস আলী। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থাকা অবস্থায় ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গাড়িচালক আনসার আলীসহ তিনি ‘গুম’ হন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। রাজনীতিবিদ স্বামীর অবর্তমানে তাহসিনা রুশদীর লুনা তার নির্বাচনি এলাকায় তৎপর রয়েছেন। ইলিয়াসের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে লুনা ২০১৮ সালে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। তৎকালীন নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করেছিল। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে থাকা তাহসিনা রুশদীর লুনা ভোটের মাঠে প্রায় এক যুগ ধরে তৎপর।
বিএনপির রাজনীতিতে ইলিয়াস অনুসারী ছিলেন সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-মধ্যনগর-ধর্মপাশা) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য নজির হোসেন। আয়তনের দিক দিয়ে সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় নির্বাচনি এলাকা সুনামগঞ্জ-১ আসনে নজির হোসেন ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে বৃহৎ এ আসনটিকে ‘বিএনপির দুর্গ’ করে তুলেছিলেন। একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি তিনি সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তার আকস্মিক মৃত্যুর পর এ আসনটিতে উত্তরসূরি হিসেবে মাঠে তৎপর সালমা নজির।
বাবার পথে ছেলেরা
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে বিএনপি মাত্র একটি আসনে জয় পেয়েছিল। সেই আসনটি হচ্ছে সিলেট সদর আসন। এ আসনটিতে (সিলেট-১, মহানগর-সদর) যে দলের প্রার্থী জেতেন, সেই দল ক্ষমতায় যায়! এমন মিথ থাকলেও তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছিল ’৯১-এর ভোট-পরবর্তী সময়ে খন্দকার আব্দুল মালিকের জয়লাভের মধ্য দিয়ে। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির উত্তরসূরি হিসেবে ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদির আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে তৎপর।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যের দায়িত্বে থাকা এম সাইফুর রহমান জীবনের শেষ নির্বাচন করেন ২০০৮ সালে সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনে। সিলেট-১ আসনে হারলেও নিজ এলাকার আসনে জয়লাভ করেন। তার ছেলে এম নাসের রহমান ২০০১ সালে উপনির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য হন। ওয়ান-ইলেভেন রাজনীতির পটপরিবর্তনে নাসের ২০০৮ সালে প্রার্থী হননি। ২০১৮ সালে এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করেছেন। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে থাকা এম নাসের রহমান বাবার উন্নয়ন দর্শন নিয়ে উন্নয়নমুখী রাজনীতির প্রচারক। আগামী নির্বাচনে এ আসনে তার মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত থাকায় ভোটের মাঠে তিনি ‘সবে ধন নীলমণি’ হয়ে আছেন।
বিএনপি রাজনীতিতে সাইফুর রহমানের অনুসারী রাজনীতিবিদ সাবেক হুইপ ফজলুল হক আসপিয়ার ছেলে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আবিদুল হক আবিদ আছেন মনোনয়নযুদ্ধে। সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনের সেখানকার একাধিকবারের সংসদ সদস্য আসপিয়া ১৯৯৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের সরকারে জাতীয় সংসদে হুইপ ছিলেন। পাশাপাশি জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। রাজনীতিতে সৎ ও সজ্জন ভাবমূর্তির ফজলুল হক আসপিয়ার সর্বশেষ নির্বাচন ছিল ২০১৮ সালে। তার মৃত্যুর পর থেকে মাঠে তৎপর ব্যারিস্টার আবিদ।
সিলেট জেলা ও মহানগরের সভাপতি, সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এম এ হক কারোনাকালে মারা যান। তিনি ২০০৩ ও ২০০৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ভোটের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিচিতির এই নেতার একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার রিয়াসাদ আজিম হক আদনান জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক পদে আছেন। নিজ এলাকা সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে দলীয় মনোনপ্রত্যাশায় তৎপর তিনি।
আছেন মেয়েরাও
সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে তৎপর রয়েছেন প্রয়াত হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। নিজ এলাকার আসনে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে হারিছ চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে জিততে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় থেকে আত্মগোপনে থাকা হারিছ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর পরিচয় প্রকাশ পায়। ৫ আগস্ট পরবর্তী বাস্তবতায় তার লাশ সিলেট এনে সমাহিত করা হয়। এরপর থেকে সামিরা মনোনয়ন প্রত্যাশায় তৎপর।
সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দুবার বিজয়ী হওয়া ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর মেয়ে সৈয়দা আদিবা হোসেন বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে তৎপর রয়েছেন। আদিবা তার বাবার স্বতন্ত্র জনপ্রিয়তা ধরে রেখে গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন গ্রাম, হাটবাজারে উঠান বৈঠক করে বেড়াচ্ছেন। ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মনোনয়ন প্রত্যাশার বিষয়টি জানিয়ে আদিয়া মাঠে তৎপর। দলীয় মনোনয়ন না পেলে তার বাবার মতো স্বতন্ত্র লড়বেন।
এ আসনে ওয়ান-ইলেভেনের সময় আলোচিত রাজনীতিবিদ যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রয়াত কমর উদ্দিনের মেয়ে সাবিনা খান পপি যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে ভোটের মাঠে তৎপর হয়েছেন। সাবিনা জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সদস্য ও যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হেমলেটসের কাউন্সিলর। জীবদ্দশায় কমর উদ্দিন ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে যুক্তরাজ্যে বিএনপির সাংগঠনিক তৎপরতা ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অবস্থানকালীন সক্রিয় ছিলেন। সাবিনা বিএনপির সেই দুঃসময়কে স্মরণ করে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।
পূর্বসূরির বলে বলীয়ান
উত্তরসূরিদের নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভাষ্য অনেকটা সাধারণ ভোটারদের মতো। তারা বলছেন, দল মনোনয়ন দিলে উত্তরসূরিরা অবশ্যই পূবসূরির পরিচয়ে অগ্রগামী থাকবেন। রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতামতও ইতিবাচক।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও বেসরকারি উন্নয়নকর্মী মোহাম্মদ আজিজুর রহমান তার পর্যবেক্ষণ থেকে জানান, ভোটের মাঠে পূর্বসূরির বলে উত্তরসূরিরা বলীয়ান। তিনি বলেন, ‘ভোটের মাঠের স্বতঃস্ফূর্ত একটি চিত্র থাকে। তা হচ্ছে অতীত পর্যালোচনা। এই পর্যালোচনাতেই উত্তরসূরিরা এগিয়ে। দলীয় মনোনয়নে মাঠের এই স্বতঃস্ফূর্ত চিত্র মূল্যায়ন দলের জন্য হলে ভালো।’
উত্তরসূরিদের উত্তাপ ও তাদের মনোনয়ন প্রত্যাশার বিষয়ে সিলেট বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতারাও মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ায় এ নিয়ে কথা বলা এড়িয়ে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেছেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে সিলেট বিভাগের তিনটি আসনে তিনজন উত্তরসূরি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এবার এ সংখ্যা বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। তবে উত্তরসূরি প্রভাবে ভোটের পরে তারা মূল্যায়িত হতে পারেন।’ সূত্র: খবরের কাগজ