ডায়াল সিলেট ডেস্ক:-

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ২৬ লাখ মানুষের একমাত্র ভরসা ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতাল।প্রতিদিন হাজারো মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে সদর হাসপাতালে ভিড় করেন। বহির্বিভাগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে উপচে পড়া ভিড়, আর ভর্তি থাকে প্রায় ৩০০-৫০০ রোগী। অথচ এসব রোগীর অধিকাংশকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে।

এদিকে হাসপাতালটিতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে  প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার ওষুধ  । এই ঘটনা শুধু সরকারি অর্থের অপচয়ই নয়, রোগীদের প্রাপ্য চিকিৎসাসেবায়ও বড় ধরনের ঘাটতির জানান দেয়।

সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এই হাসপাতালের জন্য ওষুধ সরবরাহ করলেও, সেগুলো রোগীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ফলস্বরূপ, রোগীরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি সরকারও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

সম্প্রতি তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের স্টোর রুমে কার্টন ভর্তি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের স্তূপ। কোনটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৬ মাস আগে, কোনটির ২০২৩ সালের আগস্টে।

স্টোর কিপারের দায়িত্বে থাকা রাজন দে জানান, তিনি মূলত একজন অ্যানেসথেসিয়া টেকনিশিয়ান, তবে স্টোরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের স্টোরে রাজন দে ছাড়াও আরও ৭ জন দায়িত্ব পালন করছেন- যাদের মধ্যে রয়েছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স সোহেল আহমেদ, আতিক আহমদ, মুবিন আনসারী, মেডিকেল টেকনিশিয়ান সাদেক আহমদ, রুম্মান মিয়া ও পিযুষ দেবনাথ।

তবে হাসপাতালে নবনিযুক্ত স্টোর কিপার রুপম কুমার দাস বলেন, তিনি ২০২৫ সালের মার্চ মাসে যোগ দিলেও এখন পর্যন্ত তার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।

তথ্য ও ছবি সংগ্রহে গেলে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাংবাদিককে নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, তত্ত্বাবধায়কের অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা যাবে না। তবে তিনি স্বীকার করেন, স্টোর রুমে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে যে ওষুধগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলো হলো, Syp. Kitomar রয়েছে ১ হাজার পিস। এটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে। Tab. Cefuroxime 250mg রয়েছে ৫০ হাজার ৭৫০ টি। Tab. Bisoprolol 5mg রয়েছে ২২ হাজার ৩২০ টি। Tab. Montelukas 10mg রয়েছে ছয় হাজার। Tab. Montelukas 4mg রয়েছে এক লক্ষ পিস। Tab. N-Bion রয়েছে ১৬ হাজার পিস। Tab. Rosuba 5mg রয়েছে ৫৩ হাজার ছয়শ’ পিস। Tab. Fexofenadin 120mg রয়েছে ২২ হাজার চারশ’ পিস। Tab. Naproxen 500mg রয়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার চারশ’ পিস। Tab. Atorvastatin 10mg রয়েছে তিন লাখ ৬৭ হাজার পিস। Tab. Rabeprazole 20mg রয়েছে ১০ হাজার পিস। এই ওষুধগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে গেল এপ্রিল মাসে। Tab. Glucozid 80mg রয়েছে ২৫ হাজার ৬শ পিস। Tab. Lopiral Plus 75mg রয়েছে আট লাখ ৯১ হাজার পিস। এই দুই রকমের ওষুদের মেয়াদ শেষ হয়েছে বিগত মার্চ মাসে। Tnj. Ceftriaxone 250mg রয়েছে ২২ হাজার পিস। এটির মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের জুন মাসে। Tab. Esoral 20mg রয়েছে ১৮ হাজার নয়শ’ পিস। এটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুইদিন আগে (৩১ আগস্ট পর্যন্ত ছিল মেয়াদ)। এই পনেরো পদের ওষুধগুলোর বাজার মূল্য প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই তালিকার বাইরেও আরও অনেক মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে হাসপাতালের স্টোর রুমে।

পরে ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিষ্ণু প্রসাদ চন্দের নির্দেশে স্টোর খুলে দেওয়া হয়। এরপর পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় আরও বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া যায়, যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে থেকে শুরু করে মাত্র দুদিন আগেও।

বড়পাড়া এলাকার হোসনে খা বলেন, হাড় ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। দুই ধরনের ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু তিনটি স্যালাইন কিনতে হয়েছে ৩০০ টাকায়।

নীলপুরের সাফতেরা বেগম বলেন, ভর্তি থেকেও ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। কেবল প্যারাসিটামল আর ক্যানুলা দিয়েছে। বাকি ওষুধের জন্য ১২০০ টাকা নিয়েছে।

আবু হুরায়রা নামে একজন বলেন, ডাক্তার স্যালাইন দিতে বলেছে, তাই এখানে এসছি। কিন্তু হাসপাতালের লোক বলেছে নেই, বাইরে থেকে কিনতে হবে।

সুনামগঞ্জ শহরের ফার্মেসি মালিক মুজাহিদুল ইসলাম মজনু বলেন, এতো রোগী আসার পরও কোটি টাকার ওষুধ কীভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ হলো? বিষয়টি তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে।

ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিষ্ণু প্রসাদ চন্দ বলেন, এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের কোনও ডকুমেন্ট নেই। ডকুমেন্ট না থাকলে এসব ওষুধ বাইরে পাঠানো সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশ ছাড়া এসব ওষুধ রোগীদের দেওয়া হয়নি।

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. সুমন বণিক বলেন,  আগের তত্ত্বাবধায়ক বদলি হয়ে যাওয়ায় আমি দায়িত্বে রয়েছি। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।

সদ্য বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি ২০২৪ সালের মে মাসে যোগ দিই। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলোর বিষয়ে কোনো দায়িত্ব হস্তান্তর হয়নি। কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নিতে চাইলেও বদলির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

বর্তমান সিলেট বিভাগের পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনিসুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *