দিরাই প্রতিনিধি :: হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। প্রচার-প্রচারণা আর গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। বিশেষত সরকারদলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!
এ আসনে স্বাধীনতার পর থেকে প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৮ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নাছির উদ্দিন চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এ আসনটি রাজনৈতিক সচেতন এলাকা হিসেবেই পরিচিত। অতীতে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে অবশ্য প্রত্যেকবারই দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকতো মূলত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও নাছির উদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রয়াণের পরে তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা আসেন নাছির উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নাছির উদ্দিন চৌধুরী ও জয়া সেনগুপ্তা দুজনই অসুস্থ এবং বয়সের ভারে ন্যূজ।
এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন নতুন মুখ এমন গুঞ্জন রয়েছে এলাকায়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা, শহীদ তালেব উদ্দিনের সহোদর সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট অবনী মোহন দাস, শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ আল আমিন চৌধুরী, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য ব্যারিস্টার অনুকূল তালুকদার ডাল্টন, যুক্তরাজ্য শ্রমিক লীগের সভাপতি ড. সামছুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ডিরেক্টর তানভীর তুলি, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমান মিজান।
এছাড়াও এ আসনে মহাজোটের হয়ে মনোনয়ন চাইবেন বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হামিদুল কিবরিয়া চৌধুরী আজহার। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী, সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল, যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদ, যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার আব্দুল মজিদ তাহের।
এছাড়াও এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শুয়াইব আহমদ।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। গুঞ্জন রয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্যের অসুস্থ হওয়ায় এবার দিরাই শাল্লায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীতে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে দীর্ঘদিন পর এলাকায় এসে কিছু দিন পূর্বে জয়া সেনগুপ্তা স্থানীয় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা দেন।
অপরদিকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকেই কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পেয়েছেন বলে মিছিল মিটিংয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অনেকেই অভিযোগ করছেন বর্তমান সংসদ সদস্যের নিষ্ক্রিয়তার কারণে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন কয়েক ভাগে বিভক্ত এবং দিরাই শাল্লা উন্নয়ন ব্যাহত। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অনেক বর্তমান ও সাবেক দায়িত্বশীলরা বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে নেই।
অন্যদিকে বিএনপি ও কয়েক ভাগে বিভক্ত। বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা কৌশলী প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এ আসনে ধানের শীষ প্রতীককে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নৌকার জয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নানা কৌশলে এগুচ্ছেন। তবে প্রার্থিতা নিয়ে দুই দলেই দেখা দিয়েছে বিভক্তি। বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানে প্রায় দুই দশকের পুরনো। দলের একাংশ সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরীর হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
অপর অংশের নেতা-কর্মীরা সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেলকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। পোস্টার, লিফলেট, মিছিল-সমাবেশ করে প্রচার চালাচ্ছেন তারা। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে পাবেল চৌধুরীর সখ্যতা রয়েছে বলে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশা করছেন তার নেতৃত্বে থাকা নেতা-কর্মীরা।
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ বলেন, দিরাই শাল্লা হচ্ছে বিএনপির ঘাঁটি। আমাদের নেতা নাছির উদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পরাজিত করে দিরাই শাল্লায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। নাছির উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বয়সের ভারে নতজানু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী জয়া সেনগুপ্তা বা নতুন কোনো প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচন জমে উঠবে না। আগে নির্বাচন জমে উঠতো সুরঞ্জিত-নাছির দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর মাঝে।
বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হামিদুল কিবরিয়া চৌধুরী আজহার বলেন, দিরাই-শাল্লা এক সময়ে বাম রাজনীতির ঘাঁটি ছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নাছির উদ্দিন চৌধুরীসহ এই এলাকার অনেক নেতাই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী দিরাই-শাল্লার মানুষ মহাজোটের প্রার্থীর পক্ষে রায় দেবেন এ আমার বিশ্বাস।
সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা, তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল বলেন, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আমরা তারেক রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলনে রয়েছি। যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় আর সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে তখন দল আমায় মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবো। দিরাই শাল্লার মানুষের দুর্দিনে বিভিন্ন রকমের সহায়তা নিয়ে আমি মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। দল যাকে মনোনয়ন দিবে আমরা তার পক্ষে কাজ করবো। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম বলেন, আমি মহানগরের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও হাওরপাড়ের সন্তান হিসেবে দিরাই-শাল্লার মানুষের সঙ্গে রয়েছে আমার আত্মার সম্পর্ক। জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের হাত ধরে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রমে দিরাই-শাল্লা চষে বেড়িয়েছি। প্রিয় নেতার মৃত্যুর পর দিরাই শাল্লা আওয়ামী পরিবার অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। গত দুই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম। অবশেষে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করি। হাইকমান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। বিগত মহামারি করোনা ও ভয়াবহ বন্যায় জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দিরাই শাল্লার মানুষের দুর্দিনে বিভিন্ন রকমের সহায়তা নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধে শহিদ তালেব উদ্দিনের ছোট ভাই শামসুল ইসলাম আরও বলেন, আমার আপন বড় ভাই হারানোর বেদনা বুকে ধারণ করে ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে আসছি। দলের দুঃসময়েও আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হইনি। দিরাই-শাল্লায় আওয়ামী লীগের দুর্গ গড়তে কাজ করে গেছি। আমি আশাবাদী, দলীয় মনোনয়ন পাব।
দিরাই-শাল্লার সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা বলেন, দিরাই-শাল্লার মানুষ তাদের প্রিয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বার বার এমপি বানিয়েছেন। আমাকেও তারা গত দুই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। আমি যতদিন বেঁচে থাকি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্মৃতি ধরে রেখে দিরাই শাল্লার মানুষের জন্য কাজ করে যাবো।

