নিজস্ব প্রতিবেদক :: সিলেটে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। করোনার ভয়াল থাবায় দিশাহারা রোগীর স্বজন। আক্রান্ত রোগীর বড় অংশই ফুসফুসে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতে আইসিইউর (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) প্রয়োজন হয়। ইতোমধ্যে সিলেটের সরকারি-বেসরকারির হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা কোভিড রোগীতে পূর্ণ। সিলেটে আইসিইউগুলোর শয্যাও আর ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে বিপাকে পড়ছেন করোনায় আক্রান্ত রোগী ও রোগীর আত্তীয়-স্বজন।
সরকারের তালিকায় সিলেটে সরকারি হাসপাতালে ২১টি কোভিড আইসিইউ সমমানের শয্যা থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ফাঁকা নেই একটিও। করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত সাধারণ শয্যারও সংকট তৈরি হচ্ছে। রোগী বাড়লেই তীব্র হবে সাধারণ শয্যার অভাব। এদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খালি নেই কোনো আইসিইউ বেড।
সিলেটের জকিগঞ্জ থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিলেট সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নুজু বেগম। তার শারিরিক অবস্থা খারাপ হলে প্রয়োজন পড়ে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)। কিন্তু সদর হাসপাতালে একটিও সিট ফাঁকা নেই। তার ছেলে জানান, সারা সিলেট শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঘুরে একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করা যায় নাই। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড থাকলেও কর্তৃপক্ষ করোনা রোগী ভর্তি করছে না। এতে করে অনেক রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে সিলেটে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য মোট সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে প্রায় ৬২টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ২১টি। বেসরকারি হাসপাতালে ৪১টি। এর মধ্যে সিলেটে বর্তমানে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দ মণ্ডল বলেন, কোভিড চিকিৎসায় আমরা আইসিইউর প্রাধান্য দিচ্ছি না। যে শয্যা রয়েছে, সেগুলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। রোগী বাড়লে সংকট সৃষ্টি হবে। চাইলেই আইসিইউ করা যায় না, অনেক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত নার্স, চিকিৎসক প্রয়োজন। তাই যেসব স্থানে আইসিইউ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না, সেসব স্থানে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা-উপজেলায় সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত আইসিইউ বিশেষজ্ঞরা জানান, একজন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় অবশ্যই কার্যকর আইসিইউ প্রয়োজন। আইসিইউ শুধু একটি শয্যা নয়, রোগীর চিকিৎসায় এর সঙ্গে আরও অনেক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। কিন্তু বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অনেক আইসিইউতে নেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেন্টিলেটর সুবিধা। অনেক আইসিইউতে নেই সিরিঞ্জ পাম্প, এবিজি মেশিন বা ডিফেব্রিলেটর। ফলে রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হলেও তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিদের্শনা মতে, একটি আদর্শ আইসিইউর জন্য বেশকিছু জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেমন-আইসিইউ শয্যা, আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ইনফিউশন পাম্প বা সিরিঞ্জ পাম্প, নেবুলাইজার মেশিন, পেশেন্ট মনিটর, পালস অক্সিমিটার, সাকশন মেশিন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সিলেটে বর্তমানে হাসপাতালে আসনের চেয়েও বড় সংকট নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইসিইউ)। করোনা রোগীদের জন্য পুরো সিলেট বিভাগে বরাদ্দ আইসিইউ রয়েছে মাত্র ২১টি। এর মধ্যে শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ১৬টি ও মৌলভীবাজার হাসপাতালে ৫টি। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। সুনামগঞ্জ হাসপাতালে নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেনব্যবস্থাও। শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউ বেড থাকলেও দুটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি সিলেটের দুটি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ সুবিধা রয়েছে। তবে এই দুটি হাসপাতালের ১৮টি আইসিইউ শয্যাও খালি থাকছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব বেসরকারি হাসপাতালের করোনার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যা স্বল্প আয়ের মানুষদের নাগালের বাইরে।
নগরীর আখালিয়ার মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য রয়েছে আটটি আইসিইউ বেড। এর মধ্যে কোনো শয্যা খালি নেই বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট রাশেদুল ইসলাম।
অপরদিকে, দক্ষিণ সুরমার নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য রয়েছে ১০টি আইসিইউ বেড। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীও জানিয়েছেন তাদের হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই।
নগরীর দরগাহ গেইট এলাকার নুরজাহান হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম আহমদ জানিয়েছেন, তারা করোনা রোগীদের জন্য ২৩ টি আইসিইউ শয্যা চালু করছেন। তবে দুই একটি বেড ছাড়া আর কোনো বেড খালি নেই।
এদিকে অনেক বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে নামমাত্রই সুবিধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করছেন রোগীর আত্বীয়-স্বজন। বেসরকারি পর্যায়ের অনেক হাসপাতালে শুধু শয্যা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সিলেটের হাসপাতালগুলোতে করোনা আইসিইউ বেড সংকট, কিন্তু বেশীরভাগ প্রাইভেট হাসপাতালে আইসোলেশন আছে কিন্তু আইসিইউ ব্যবস্থা থাকলেও করোনা রোগী নেয়া হচ্ছে না।
ডায়ালসিলেট/এম/এ/