ডায়ালসিলেট ডেস্ক::করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে আসছে ডেঙ্গি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ রোগের তুলনায় যেটিকে শিশুর জন্য বেশি ঝুঁকি। রোববার সর্বোচ্চ রেকর্ড সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মধ্যে রাজধানীতেই সবচেয়ে বেশি।

মগবাজার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ডেঙ্গি জ্বরে আক্রান্ত এক শিশুর অভিভাবক আক্ষেপ করে বলেন, ডেঙ্গি সবকিছু তছনছ করে দিল।

রাজধানীর উইলস্ লিটল ফ্লাওয়ার্স স্কুলের মনিটরিং অফিসার মোসলেহ উদ্দিন তরুণ জানান, এইডিস মশবাহিত এই রোগে মাসখানেক আগে তিনি নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও অনাগত সন্তানকে হারিয়েছেন।

গত ১৪ জুন হঠাৎ জ্বর আসে তরুণের স্ত্রী ফাতেমা বেগমের, ১৬ জুন রিপোর্টে ধরা পড়ে ডেঙ্গি; ততক্ষণে রক্তে প্লেইটলেটস নেমে আসে ১৮ হাজারে।

এরপর আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। প্লেইটলেটস দেওয়ার পরও অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ২০ জুন পেটেই তার সন্তান মারা যায়। ২৬ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি ফাতেমাকে।

তরুণ মনে করেন, তাদের শান্তিনগরের বাসার পাশের ময়লার স্তূপের পাশে জমা পানি থেকেই এইডিস মশার বিস্তার ঘটেছে।

তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতিদিন অনেকে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আমার শিক্ষার্থী বাচ্চাটাও আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গি করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ৬ দিনে আমার সংসারটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার থাকলে, নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটালে হয়ত আমাকে সব হারাতে হত না।

তারা বলছেন, শেষ পর্যায়ে রোগী আসায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে রোগ নির্ণয়ে দেরি হওয়ায় ডেঙ্গি রোগীদের বেশি ভুগতে হচ্ছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণেও জ্বর যেমন হয়, ডেঙ্গিতেও তাই হয়। করোনাভাইরাস আর ডেঙ্গির জোড়া প্রকোপে ব্যাপক মৃত্যু ঠেকাতে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও এইডিস মশার বংশবিস্তার থামাতে জোর দিতে বলছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ডেঙ্গির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে সব হাসপাতালে নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে।

শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গি নিয়ে ঢাকায় ১৬৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হওয়ার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ৬৭৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।

চলতি বছর ডেঙ্গি সন্দেহে ৪টি মৃত্যুর তথ্য এসেছে আইইডিসিআরে। বছরের প্রথম ৬ মাসে ৩৭২ জন রোগী হাসপাতালগুলো চিকিৎসা নিয়েছেন। যেখানে জুলাই মাসেই হাসপাতালে এসেছেন ২ হাজার ৯০ জন ডেঙ্গি রোগী।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গির প্রকোপ অনেকটা কম ছিল।

গত বছর ১ হাজার ৪০৫ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গির চিকিৎসা নেন। চলতি মাসেই ডেঙ্গিতে এর চেয়ে বেশি রোগী আক্রান্ত হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের উপর চাপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেকর্ড ছাড়াচ্ছে ডেঙ্গি, চাপ বাড়ছে হাসপাতালে

ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে এইডিস মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বরে যেভাবে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে, তাতে অনেক শিশুও পাচ্ছেন তারা।

জ্বর, মাথা ব্যথা, চোখে ব্যথা, শরীরে ব্যথা, মুখ থেকে রক্তক্ষরণ, পেট ফুলে যাওয়া, শরীরে পানি আসা, গায়ে র‌্যাশ ওঠা- এসব লক্ষণ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে।

দেশে এখন দ্বিতীয় সর্বাধিক ডেঙ্গি রোগী ভর্তি রয়েছে ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, শুক্রবার পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতালটিতে ৬৪ জন ডেঙ্গি রোগী ভর্তি রয়েছেন।

তবে সেন্ট্রাল হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের ইনচার্জ ও কনসালটেন্ট সুজিত কুমার রায় বলেন, এই সংখ্যা ৯০ এর বেশি হবে, যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। গত এক সপ্তাহে ডেঙ্গির প্রকোপ অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের এক সপ্তাহ আগে ১০ থেকে ১২ জন ডেঙ্গি রোগী ছিল। গত তিন দিনে পেডিয়াট্রিকে ৪০ জনেরও বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। আর মেডিসিনে ৫০ জনের মতো ডেঙ্গিরোগী রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গি রোগী ভর্তি থাকা রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক কাজী মো. রশিদ উন নবী জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যে ৯৬ জন রোগী ভর্তি ছিল, তাদের ১২ জন শিশু। এছাড়া চার দিন আগে ডেঙ্গি ‘শক সিনড্রোম’ নিয়ে আসা ১১ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে টেস্ট করার আগেই। জ্বর নিয়ে বেশি রোগী আসছে। যারা আসছেন, তাদের প্লেইটলেটস কম থাকে। আমরা ট্রিটমেন্ট দিচ্ছি, কিন্তু রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে।

সরকারি তথ্যের তুলনায় রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা এই চিকিৎসকের।

রশিদ উন নবীর পরামর্শ, জ্বর এলে ডেঙ্গির টেস্ট করে চিকিৎসকের পরামর্শে চলতে হবে। জ্বরের সঙ্গে বমি বা পেটে ব্যথা থাকলে অথবা হাত-পায়ে পানি আসলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক শফি আহমেদ জানিয়েছেন, প্রতিদিনই ৭-৮ জন শিশু ডেঙ্গি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। তার হাসপাতালে ভর্তি থাকা ২৫ জন রোগীর মধ্যে দুইজন আইসিইউতে রয়েছে। ডেঙ্গি ফিভার ও ডেঙ্গি শক সিনড্রোম নিয়ে আসছে। এগুলোতে অবস্থাটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। ৪ জন শিশু মারা গেছে। শেষ পর্যায়ে তারা আসছে এবং তাদের কো-মরবিট কনডিশন নিয়ে আসছে। মেনিনজাইটিস, লিউকোমিয়া আক্রান্তরা মারা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আউটডোরেও অনেক রোগী আসছে। অনেক শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের প্র্যাকটিসেও আমরা পাই। অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে বোঝা যাবে, ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়বে কি না?

শিশুদের জন্য করোনাভাইরাসের চেয়ে ডেঙ্গিকে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বলেন, করোনায় শিশুদের মাইল্ড সিম্পটম হয় এবং তাদের ঝুঁকিটা কম থাকে। কিন্তু ডেঙ্গিতে শিশুরা অনেক ঝুঁকিতে থাকে।

লকডাউনে অন্যান্য রোগীর সংখ্যা কম হওয়ায় এখনও রোগী ভর্তি নিতে পারলেও আইসিইউ সবসময় পূর্ণ থাকছে বলে জানান তিনি।

আক্রান্ত শিশুদের বেশি করে পানি ও পানি জাতীয় খাবার দেওয়ার তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক শফি আহমেদ বলেন, সবাই মনে করে, জ্বর কমলেই ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু ডেঙ্গি জ্বর কমার সাথে সাথে জটিলতা বাড়তে থাকে। সেজন্য জ্বর কমার ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত খুবই খেয়াল রাখতে হবে।

ডেঙ্গি থেকে বাঁচতে ছোট শিশুদের ফুলহাতা জামা-কাপড় পরানো এবং সবসময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না। অনেক সময় জ্বর প্যারাসিটামলে না কমলে অনেকে ক্লোফেনাক সাপোজিটরি ব্যবহার করেন। এই জাতীয় জ্বর কমানোর ওষুধে ডেঙ্গি রোগীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে যেতে পারে। এগুলো কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। ডেঙ্গি হলে বাসায় থাকা নিরাপদ না, হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই উত্তম।”

 

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বাসার আনাচে কানাচে যেখানে মশা থাকতে পারে সেখানে স্প্রে করতে হবে। মশার বংশবিস্তার যাতে না হয় সেজন্য ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে, কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহী রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফসানা আলমগীর খান বলেন, মৌসুমের আগেই প্রচার হয়েছে। ছয়টি হাসপাতালকে ডেঙ্গি রোগের জন্য ডেডিকেটেড করে দেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ছোট করে হলেও যেন একটি ডেঙ্গি কর্ণার থাকে, সেজন্য আমরা সব হাসপাতালে চিঠি পাঠিয়েছি। শুধু ডেঙ্গির জন্য একটা টিম ডেডিকেট করে দিতে বলছি, যেটা ২০১৯ সালেও ছিল।

ডা. আফসানা আলমগীর খান বলেন, কেউ যেন চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে না আসে, অন্তত যেন টেস্টটা করার সুযোগ পায়। এনএস১ টেস্ট যেন বিনামূল্যে করানো হয়, সেজন্য সব হাসপাতালকে আমরা বলে দিয়েছি। চিঠিটা হয়ত রোববারের মধ্যে পেয়ে যাবে তারা।

ডায়ালসিলেট এম/

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *