ডায়ালসিলেট ডেস্ক::দেশব্যাপী কঠোর লকডাউনের মধ্যে হঠাৎ তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। লকডাউন উপেক্ষা করে জীবিকার তাগিদে জীবন হাতে নিয়ে মানুষ ঢাকা ফিরছেন। ফেরি, লঞ্চসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে কর্মজীবীদের ঢল নেমেছে। এসব যানবাহনে মানুষ গাদাগাদি করে ফিরছেন। সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নিয়ম লঙ্ঘিত হচ্ছে। সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ আরও বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক বিধিনিষেধ বা লকডাউন দিয়ে কোনো ফল পাওয়া যাবে না, বরং পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে কল্পনাতীত করোনার সংক্রমণ আরও বাড়বে: জাহিদ মালেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আজ (রোববার) থেকে গার্মেন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন; কিন্তু তারা স্বাস্থ্যবিধি মানেননি। ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়বে। তিনি বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গিয়ে যদি জীবনই না বাঁচে, তাহলে কী লাভ। সংক্রমণের হার বাড়ছে। কোভিড চিকিৎসায় যত শয্যা বাড়ানো সম্ভব, সেটা বাড়ানো হয়েছে। হাসপাতালে আর একটি শয্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই। প্রতিদিন দুইশর বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সেটি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। জীবনের জন্য জীবিকা দরকার, আবার জীবিকার জন্য জীবনও থাকতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন তুলে দিয়েছিল। তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। আমেরিকা মাস্ক ব্যবহার উঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণ বাড়ায় আবার মাস্ক ব্যবহার শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়া লকডাউন উঠিয়ে দিয়েছিল; কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এবার কারফিউ দিয়েছে। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানি, তাহলে সংক্রমণ কমাতে পারব না। অর্থনীতির চাকা সচলে বাড়ছে ঝুঁকি : সায়েদুর রহমান লকডাউন চলমান অবস্থায় গার্মেন্ট শিল্পগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রাণের বিনিময়ে অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য যে ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে, এর সব চাপ বহন করতে হবে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে। দেশের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের পক্ষ থেকে এই কথাটা উদ্বেগসহ স্পষ্ট করেই বলেছি। এরকম একটি অবস্থায়ও কী করা যেতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাল-সবুজ কাপড়ের মাস্ক, লাখ লাখ নমুনা পরীক্ষা এবং বয়স্ক যারা অন্যান্য অসুখে ভুগছেন তেমন মানুষ-গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সারা দেশে মোবাইল ইউনিট চালু করা জরুরি। সেই সঙ্গে এটাও বলেছি যে, লাল-সবুজ রঙের মাস্ক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমগ্র জাতিকে মনোজাগতিকভাবে যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, প্রতিটি মোবাইল ইউনিটে ৬ থেকে ৭ সদস্যের প্রশিক্ষিত একটি দল কাপড়ের মাস্ক, নমুনা পরীক্ষা এবং টিকাদানের সুবিধা-সামর্থ্যসহ সারা দেশে ঘুরে ঘুরে মানুষের দোরগোড়ায় সুবিধাগুলো পৌঁছে দিতে পারে। যেন স্বল্পতম সময়ে নিচের তিনটি লক্ষ্য অর্জন করা যায় : ১. প্রতিমাসে ২০ কোটি লাল-সবুজ কাপড়ের মাস্ক সারা দেশে জনগণের মাঝে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। ২. দেশের করোনা পরিস্থিতি জানতে এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষামুলক ব্যবস্থা নিতে প্রতিদিন অন্তত ২ লাখ নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষায় যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে, তাদের সুরক্ষামূলক নজরদারিতে রাখতে হবে। ৩. প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ লাখ টিকাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুততম সময়ে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বলেন, এর পাশাপাশি দেশের সব বিলবোর্ডগুলোয় এক মাসের জন্য শুধু এই মহামারি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করে জাতিকে চিন্তার ক্ষেত্রে এক সুতায় বাঁধার চেষ্টা করতে হবে। এখনো যারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিষয়টি হালকাভাবে দেখাছেন, তারা যেন এক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেন। দুসপ্তাহের মধ্যে অবস্থা হবে ভয়াবহ: এম এ আজিজ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ যুগান্তরকে বলেন, ঈদের পর দুই সপ্তাহের লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ বর্তমানে চলমান। কিন্তু সংক্রমণ কমছে না। কারণ ঈদের আগের ৮ দিনের বিধিনিষেধ শিথিলের কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য কলকারখানা খুলে দেওয়া এবং লাখ লাখ শ্রমিকদের ঢাকা আসায় সংক্রমণ কল্পনাতীত বেড়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সামনের এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশে একটা ভয়াবহ পরিস্থিরি সৃষ্টি হবে। এ ধরনের লাকডাউন বা বিধিনিষেধ দিয়ে সংক্রমণ কমনো সম্ভব নয়। দেশের করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে টিকাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, গণটিকা কর্মসূচি আরও বাড়াতে হবে। সপ্তাহে ৬০ লাখ টিকা দেওয়ার যে কর্মসূচি স্বাস্থ্য মন্ত্রষালয়ের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে, সেটি যে কোনো মূল্যে সফল করতে হবে। অধ্যাপক আজিজ বলেন, বর্তমানে দেশের কোনো হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। দেশে কোভিডের সঙ্গে ডেঙ্গি সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোভিড এবং ডেঙ্গির এই ভায়াবহ অবস্থা নেই। দুটি রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা আলাদা। একই সঙ্গে এ দুটি রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের হাসপাতালগুলোয় দুই ধরনের রোগীর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এটা শুধু ঢাকায় না, সারা দেশে চিকিৎসকরা এই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমন সময় দেশের সব শিল্প-কলকারখানা খুলে দেওয়া এবং লাখ লাখ মানুষকে রাজধানীতে আনার সরকারি প্রচেষ্টা চিকিৎসাবিজ্ঞান সমর্থিত নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সিদ্ধান্ত সংক্রমণ অনেক বাড়িয়ে দেবে। ঢাকায় ফেরা সবাই গার্মেন্ট শ্রমিক নন: মোহাম্মদ হাতেম ঢাকায় ফেরা সব মানুষ গার্মেন্ট শ্রমিক নন। অথচ পুরো দায় গার্মেন্ট মালিকদের নিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএকএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, গ্রাম থেকে যারা ঢাকায় আসছেন, তারা যে সবাই গার্মেন্ট শ্রমিক, এটা নিশ্চিত করল কে? মোবাইল অপারেটরদের তথ্য বলছে, ঈদে শহর থেকে এক কোটির বেশি মানুষ গ্রামে গিয়েছে। ঢাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকের সংখ্যা কি এক কোটি? নিশ্চয় না। এর মানে, শ্রমিকদের সঙ্গে অন্য কাজে নিয়োজিতরাও আসছে। কিন্তু পুরো দোষ গার্মেন্ট মালিকদের ঘাড়ে পড়ছে। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের ঢাকায় ফিরতে চাপ দেয়নি। ৩ কারণে এমন হতে পারে। প্রথমত, ঈদে শ্রমিকদের গ্রামে যেতে বারণ করা হয়েছিল। সবাইকে কারখানার আশপাশে থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অনেকে নির্দেশনা অমান্য করে গ্রামে গিয়েছে। এখন যখন কারখানা খুলেছে, তখন তারা হুড়মুড়িয়ে ঢাকায় প্রবেশ করছে চাকরি হারানোর ভয়ে। কিন্তু মালিকরা তো স্পষ্ট করে বলেছে, কেউ ফিরতে না পারলে চাকরি যাবে না। দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের বেতনের সময় এসে গেছে। অনেকে বেতনের জন্য হাজিরা দিতেও আসছেন বলে মনে হয়। তৃতীয়ত, গার্মেন্টে সুপারভাইজার পদে কর্মরতরা নিজের পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য অতি উৎসাহিত হয়ে নিজের লাইনের শ্রমিকদের ফোন বা এসএমএস দিয়েছে। এ বিষয়ে মালিকরাও জানেন না।
ডায়ালসিলেট এম/