ডায়ালসিলেট ডেস্ক রিপোর্ট :: বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টারশেল ছোড়ার এক সপ্তাহের মাথায় ফের যুদ্ধবিমান থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ছুড়েছে মিয়ানমার বাহিনী। কড়া প্রতিবাদের পরও মিয়ানমার সীমান্ত লঙ্ঘন করে চলেছে ।
গতকাল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বিস্ফোরিত হয়েছে। ভূখণ্ডের ১২০ মিটারের ভেতরে বিস্ফোরিত হলেও এ ঘটনায় ও কেউ হতাহত বা আহত হননি । ঘটনার ৬ দিন আগেও ২৮শে আগস্ট মর্টারের শেল নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসে পড়েছিল। তবে সেটি বিস্ফোরিত হয়নি।
পরপর এ ধরনের দুটি ঘটনা ও মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ে যারা জুম চাষ করেন তারা চাষে না গিয়ে এখন বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের রেজু আমতলী সীমান্তের কাছাকাছি ওয়ালিডং পাহাড়ে গোলাগুলি হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে সীমান্তের ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের ওপারে (মিয়ানমার ভূখণ্ডে) প্রচুর গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। এ সময় দুটি যুদ্ধ বিমান ও দুটি যুদ্ধ হেলিকপ্টার ওয়ালিডং পাহাড়ি এলাকায় বোমা নিক্ষেপ করে।
নো ম্যান্সল্যান্ডের বাসিন্দারা (রোহিঙ্গা) জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন ধরে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে দফায় দফায় গুলিবর্ষণের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, গতকাল সকাল থেকে তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যাচ্ছে। গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টানটু সাহা জানান, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক আছে। তারা যাতে ভয় না পায় তাদেরকে সচেতন করার জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করা দরকার সেটি করছি। তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তবে সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়াতে বিজিবি সব দেখাশোনা করে। বান্দরবানের পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে ৪০ ও ৪১ নম্বর সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান থেকে আট-দশটি গোলা ও দুটি হেলিকপ্টার থেকে ৩০-৩৫ রাউন্ড গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।
তাদের ছোড়া দুটি গোলা ৪০ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি শূন্যরেখার প্রায় ১২০ মিটার বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়েছে। এ ছাড়া ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৪ ও ৩৫ সীমান্ত পিলারের তুমব্রু এলাকা থেকে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে ভারী অস্ত্রের গোলাগুলি শোনা যায়। সেখানে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প অবস্থিত।
মূলত বিজিপির ওই ক্যাম্পের আশেপাশে গোলাগুলি চলছে। মুরিঙ্গাঝিরি বিজিপি সীমান্ত চৌকি থেকেও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এদিকে, ২৮শে আগস্ট তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল পড়ার ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, আমাদের এখানে এসেছে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে। হঠাৎ করে চলে এসেছে। এ নিয়ে আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেসও করেছি। তারা বলেছে, আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে এজন্য তারা সতর্ক থাকবে। ওই সময় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অবিস্ফোরিত মর্টারশেলটি বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়ার ঘটনাটি দুর্ঘটনা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
এছাড়া তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছে। তাকে একটা মৌখিক নোটের মাধ্যমে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। যে ঘটনা ঘটেছে, সেটার ব্যাপারেও আমরা নিন্দা প্রকাশ করেছি।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সব সীমান্তেই আমরা সতর্ক থাকি তবে মিয়ানমার সীমান্তে বেশি সতর্ক থাকি। কারণ আমরা একটা বিষয়ে খুব সোচ্চার এ ঘটনার জের ধরে নতুন করে যেন কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে। গোলা ছোড়ায় সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর ঝুকি নিয়ে তিনি বলেন, সাবধানে না চললে ঝুকি থেকেই যায়।
আমরা টহলের পাশাপাশি নিজেরা সতর্ক থাকছি। সীমান্তবর্তী জনগণকেও সতর্ক করেছি বহুবার। তারা সেগুলো মেনে চললে ঝুঁকি থাকবে না। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে জুমচাষিরা পাহাড়ে যাচ্ছে না বলে মনে করছিনা। এটি তাদের নিজেদের প্রয়োজনে যাওয়া না যাওয়া নির্ধারণ করে। যে গোলা পড়ছে সেগুলো কতটুকু শক্তিশালী ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা কেমন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ নিয়ে আরও তদন্তের বিষয় আছে। আর যুদ্ধে ব্যবহৃত যেকোনো গোলাবারুদই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যদি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তাদের ছোড়া গোলা পড়ে থাকে তবে প্রথমেই ডিপ্লোমেটিকভাবে প্রটেস্ট করা দরকার। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারের কাছে শক্ত বার্তা দেয়া দরকার। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে পাহাড়ি মানুষদের জীবন প্রবাহ ব্যাহত হবে। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-মারামারি করছে সেটা তাদের সীমান্তে করুক। কিন্তু আমাদের সীমান্তে পড়লে ডিপ্লোমেটিকভাবে সরকারের জানানো উচিত বলে মনে করি।