বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও হয়নি

ডায়াল সিলেট ডেস্ক :: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের সাধারণভাবে রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংগঠন ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন- হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতো তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও এসব সংগঠনের সদস্যদের তালিকা করা হয়নি।
যদিও এর আগে রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল সরকার। কিন্তু তুমুল বিতর্কের মুখে তা বাতিল করা হয়। এরপর মূলত পথ হারিয়েছে রাজাকারের তালিকা করার উদ্যোগও। স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করার কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তালিকা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদীয় উপ-কমিটির কাছেও পাওয়া গেলো না আশাব্যঞ্জক কোনো তথ্য। তাই এ সরকারের মেয়াদে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ২০১৯ সালে বিজয় দিবসের আগের দিন, অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যাতে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নাম আসে। কিন্তু এ তালিকায় অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর আরও দুই ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। ফলে তালিকাটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় সারাদেশে।
সবশেষ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তালিকাটি। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে আবারও তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়। এরপর প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হতে চললেও রাজাকারের তালিকা এখনো প্রকাশ হয়নি।
বিতর্কিত সেই তালিকার বিষয়ে তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, এ তালিকা আমরা প্রণয়ন করিনি, প্রকাশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা যা পেয়েছি তাই হুবহু প্রকাশ করেছি।
এদিকে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ জারি করা হয়।
রাজাকারের তালিকা করার অগ্রগতি জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, রাজাকারের তালিকা আমরা করছি না। এটি করার জন্য শাজাহান খানের (সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী) নেতৃত্বে সংসদীয় উপ-কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
রাজাকারের তালিকা করতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় উপ-কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় তারা মিটিংয়েই বসতে পারছিলেন না। শেষে চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন সংসদীয় সাব-কমিটি গঠন করা হয়। আগের মতো এ কমিটিতেও আহ্বায়ক হন শাজাহান খান। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের এ বি তাজুল ইসলাম।
এরপর সাব-কমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাছে রাজাকারের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠায়।
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক শাজাহান খান বলেন, ৪৯২ উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫০-এর বেশি উপজেলা থেকে রাজাকারদের তালিকা পাওয়া গেছে। এ তালিকা যাচাই-বাছাই চলছে। কারণ গড়ে তালিকা করে পাঠানো হয়েছে। কে রাজাকার, কে আলবদর, কে আলশামস তা পরিষ্কার করা হয়নি। এজন্য আমাদের এটা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
তালিকা করার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে বসবেন জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, আমরা মন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা চাইবো। কারণ তালিকা প্রকাশ করার পর আলোচনা-সমালোচনা হবে। নির্ভুল তালিকা করতে চেষ্টা করছি, তবে শতভাগ নির্ভুল করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও হয়নি : এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও এখন পর্যন্ত করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে দফা দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার কাজ শেষের দিকে। নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) ছাড়া অন্য ক্যাটাগরির মুক্তিযোদ্ধার আবেদন নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গত ১৮ মে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।
তবে যে সব আবেদন এরই মধ্যে গৃহীত হয়েছে এবং যাচাই-বাছাই বা আপিল পর্যায়ে রয়েছে সেগুলো নিষ্পন্ন করার কাজ চলমান। এ কাজ শেষ হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পূর্ণাঙ্গ হবে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এতে স্থান পেয়েছেন এক লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে চলতি বছরের (২০২২ সাল) ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেট প্রকাশ হতে দেখা গেছে।
তবে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ নির্ভুল তালিকা করতে পারেনি কোনো সরকার।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *