মনজু বিজয় চৌধুরী॥ দেশের চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বর্ধিত করে ৩০০ টাকা করার দাবিতে ২০২২ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশের চা-বাগানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করেছিলেন। সে সময়ে দফায় দফায় শ্রমিকদের সাথে বাগান মালিকপক্ষ ও সরকারের প্রতিনিধিরা বৈঠক করলেও তা সফল হয়নি। দেশের সাধারণ চা শ্রমিকদের একটাই দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তারা তা মেনে নেবেন। অবশেষে ওই বছরের ২৭ আগস্ট গণভবনে চা বাগানের মালিকপক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে আড়াই ঘন্টাব্যাপী বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চা শ্রমিকদের নিন্মতম মজুরি ১৭০ টাকা ঘোষণা করেন। বৈঠকে চা শ্রমিকদের দাবি ছিল নতুন কাঠামো অনুযায়ী ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মজুরি দিতে হবে। সেই হিসাবে ওই সময় থেকে শুরু করে গত বছরের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের বকেয়া শ্রমিকদের দাবি অনুয়ায়ী ৩০ হাজার টাকা। এ বকেয়া মজুরির বিষয়ে পরে শ্রমিক প্রতিনিধি ও মালিকপক্ষ বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়। পরবর্তীকালে রাজধানীতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর আহ্বানে চা বাগান সমূহের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যকার এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বকেয়া মজুরি জনপ্রতি চা-শ্রমিকরা পাবেন ১১ হাজার টাকা। যা তিন কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে বলে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এসব সিদ্ধান্তের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বা হচ্ছে এবং পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নিয়ে সাধারণ চা শ্রমিকদের ভাবনা কি এ নিয়ে দেশের চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের মুখোমুখি হলে তারা ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের সে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে নির্ধিদ্বায় মেনে নিয়েছি। তবে এখনো আমরা মালিকপক্ষ কর্তৃক অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছি। দেশের চা শিল্পের ইতিহাস ১৬৯ বছরের হলেও এখনো আমাদের ভূমির অধিকার দেয়া হয়নি। আমরা এখনো নিজ দেশে পরবাসী। বাগানের জমিতে মালিকপক্ষ কর্তৃক নির্মিত ঘরের অধিকাংশই ঝরাজীর্ণ। ৮ হাত বাই ১২ হাতের প্রতিটি ঘরে জীবনের ঝুকি নিয়ে বসবাস করছি আমরা। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ঘরগুলো মেরামতের বিধান থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এমনকি নিজে ঘরের মেরামত করতে চাইলে কোম্পানি (চা বাগান কর্তৃপক্ষ) বাধা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া চা শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির ৪ হাজার টাকা করে প্রথম কিস্তি মালিকপক্ষ পরিশোধ করলেও বাকি টাকা দেয়া হচ্ছে না। কবে দেয়া হবে তাও তাদের জানানো হচ্ছে না।’
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার প্রেমনগর চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সুভাষ ভৌমিক বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে চা শ্রমিকদের কাঁচা ঘরবাড়ি কোম্পানি কর্তৃক মেরামত করে দেবার কথা। কিন্তু বর্তমান বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ঘর মেরামত করে না দেয়ায় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে আমরা এসব ঘরে বসবাস করছি। এছাড়া আরো নানাবিদ সমস্যায় রয়েছেন বর্তমানে প্রেমনগর চা বাগানসহ দেশের অন্যান্য চা বাগানের সাধারণ শ্রমিকরা। এ নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল আমরা বাগানে তিন ঘন্টা কর্মবিরতী পালন করি। আমাদের দাবিগুলো দ্রুত সমাধান করা না হলে আমরা আরো বৃহত্তর কর্মসূচি দেবো।’
শ্রীমঙ্গলের ভুরভুরিয়া চা বাগানের নিবন্ধিত নারী শ্রমিক সাবিত্রী মৃধা বলেন, ‘চা বাগানে আমাদের মজুরি হলো ১৭০ টাকা। কিন্তু বাজারে তো জিনিষের অনেক দাম। বর্তমানে এ টাকা দিয়ে চলা দায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি বর্তমান মৌসুমে আমাদের প্রতি আরেকটু সহায় হতেন তবে আমরা পরিবার নিয়ে একটু স্বস্থিতে বাঁচতে পারতাম। আর আমাদের ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগি। এগুলো মেরামত ও আমাদের ভূমির অধিকার দেবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’
মৌলভীবাজারের দেওরাছড়া চা বাগানের শ্রমিক ব্রিটিশ ঘাটুয়াল বলেন, ‘চা বাগানের অনেক শ্রমিক পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ১০ জন পর্যন্ত আছে। তবে বাগানের কাজ পায় পরিবারের ১ জন সদস্য। তার বর্তমান মজুরি দৈনিক ১৭০ টাকা। অধিকাংশ শ্রমিক পরিবারেই পরিবারের বাকি সদস্যরা ওই টাকার উপর নির্ভরশীল। এবারের পহেলা মে শ্রমিক দিবসে আমাদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’
ভুরভুরিয়া চা বাগানের নারী চা শ্রমিক মনি মৃধা বলেন, ‘হামনে ১৭০ টাকা দিয়ে চলে না। হামনে কে জিনিসপাতিকে বহুত দাম। হামনে এক বেলা খানিকে দুবেলা উপাস, পানি খা কে চলে। এভাবে হামকে চলে না।’
ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক সর্দার মানিক গোয়ালা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মজুরি ১৭০ টাকা করে দিয়েছেন। সেজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়া আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা আমাদের পাবার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ এখনো উদাসিন। পহেলা মে শ্রমিক দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি আপনি আমাদের বিষয়ে দয়া করে আরেকটু উদ্যোগ নিন। বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের মজুরির বিষয়টি যদি পুর্নবিবেচনা করেন তবে আমরা দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবো।’
ভুরভুরিয়া চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুধীর রিকিয়াশন বলেন, ‘জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই তিনি আমাদের হাজিরা ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা করে দিয়েছেন। আমাদের বাড়তি হাজিরা যা দেবার কথা না দেয়া হচ্ছে না। এ পর্যন্ত মাত্র ৪ হাজার টাকা পেয়েছি। বাকি টাকা দ্রুত দেবার দাবি জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্টের সভাপতি পরিমল সিং বাড়াইক বলেন, ‘আমরা দেখেছি আগের তুলনায় বর্তমান চা শ্রমিকদের অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায়। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধগতি তার সাথে কিন্তু চা শ্রমিকদের এই মজুরি কোনভাবেই কুলানো যাচ্ছে না। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করবো যাতে এ মজুরি আরো কিছু বৃদ্ধি করা হোক। কমপক্ষে ৩০০ টাকা যদি মজুরি হয় তাতে কষ্টকর হলেও চা শ্রমিকরা চলতে পারবে। চা শ্রমিকদের যে ট্রেড ইউনিয়ন অর্থাৎ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন যারা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলে, সে ট্রেড ইউনিয়নের বর্তমান যে নেতৃত্ব অনেকটা দুর্বল। তারা কথা বলতে পারছে না। তারা সরকারের সাথে লিয়াজো মেইনটেন করতে পারছে না, মালিকপক্ষের সাথে তারা কথা বলতে পারছে না, মালিকপক্ষ তাদের কথা শুনতে রাজি নয়। অনেকবার বৈঠক হয়েছে এগ্রিমেন্ট করার জন্য কিন্তু তারা এগ্রিমেন্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২২ সালে হিসেব ছিল ১৯ মাস তারা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারনে ১৯ মাসের বকেয়া মজুরি মালিকপক্ষের সাথে কথা বলে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ১১ হাজার টাকা মেনে নিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার টাকা দিয়েছে। শ্রমিকের টাকা ভাগ করার সিস্টেমটা আমরা বুঝতে পারলাম না, কেন ভাগ হবে? এটাতো শ্রমিকদের পাওনা, তাদের অধিকার। এবারের শ্রমিক দিবসে চা শ্রমিকদের অধিকার সমুন্নত রেখে শ্রমিক-মালিক যৌথভাবে চা শিল্প এগিয়ে নিয়ে যাবে সে প্রত্যাশা করছি।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, ‘পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি আমরা পৌনে দুইশত বছর ধরে চা বাগানে আছি, কিন্তু আমাদের ভূমি নেই। একেবারে শতভাগ ভূমিহীন আমরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীনদের ভূমি দিচ্ছেন। আমরা যে ভূমিতে বসবাস করছি, আমাদের যে বসতভিটা আছে সেসব জমিগুলো আমাদের নিজ নিজ নামে করে দেবার অনুরোধ জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আমরা এ দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক পেছনে আছি। যদি ভূমির অধিকার পেয়ে যাই তাহলে হয়তো আমরা একদাপ এগিয়ে যাবো। পাশাপাশি আমাদের অনেকগুলো দাবি আছে বাসস্থান, মজুরিসহ চাকরীক্ষেত্রে আমাদের কোটা করে দেবার দাবি জানাচ্ছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করছে, শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মেধাবীদের তুলনায় আমাদের সন্তানরা কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাই চাকরীক্ষেত্রে কম্পিটিশন করে আমরা পারবো না। তাই আমাদের কোটায় অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানাচ্ছি। যেভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি হচ্ছে তা নিয়ে ১৭০ টাকা মজুরিতে চা শ্রমিকদের চলার পথ অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা চা বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন চা সংসদের সাথে এ ব্যাপারে বসবো।’
উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে চা জনগোষ্ঠী ৭ লক্ষাধিক। তার মধ্যে দেশের নিবন্ধিত ১৬৭টি চা বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছেন প্রায় ৯৪ হাজার আর কেজুয়্যাল বা অনিয়মিত শ্রমিক রয়েছেন ৪০ হাজার। ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণির বাগানগুলোতে নিবন্ধিত শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে হয় ৬৯ টাকা, ২০১৫ সালে হয়েছে ৮৫ টাকা, ২০১৬ সালে ১০২ টাকা, ২০১৮ সালে ১২০ টাকা আর বর্তমানে ১৭০ টাকা।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *